ইন্দিরা
এই বলিবা মাত্র মোগল ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিল। পলায়ন করিবার সময় আমি তাহার দাড়ি ধরিলাম—পরচুলা খসিয়া আসিল। মোগল বলিল, “মরণ আর কি! তা এ বোকাটি নিয়ে ঘর করিবি কি প্রকারে?” এই বলিয়া সে পলাইল। আমি দাড়িটা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া যমুনা দিদিকে উপহার দিলাম। উ-বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “ব্যাপার কি?”
কামিনী বলিল, “ব্যাপার আর কি? তুমিই দাড়িটা পরিয়া চারি পায়ে ঘাসবনে চরিতে আরম্ভ কর।”
উ-বাবু বলিলেন, “কেন, মোগল কি জাল?”
কা। কার সাধ্য এমন কথা বলে! শ্রীমতী অনঙ্গমোহিনী দাসী কি জাল মোগল হইতে পারে! আসল দিল্লীর আমদানি।
একটা ভারি হাসি পড়িয়া গেল। আমি একটু মন:ক্ষুণ্ণ হইয়া চলিয়া আসিতেছিলাম, এমন সময়ে পাড়ার ব্রজসুন্দরী দাসী একখানি জীর্ণ বস্ত্র পরিয়া একটি ছেলে কোলে করিয়া উ-বাবুর কাছে গিয়া দু:খের কান্না কাঁদিতে লাগিল। “আমি বড় গরীব; খেতে পাই না; ছেলেটি মানুষ করিতে পারি না।” উ-বাবু তাহাকে কিছু দিলেন। আমরা দুইজনে দ্বারের দুই পাশে। সে যখন দ্বার পার হয়, কামিনী তাহাকে বলিল, “ভাই ভিখারিণি! জান ত বড় মানুষের কাছে কিছু ভিক্ষা পাইলে দ্বারবানদের কিছু ঘুস দিয়ে যেতে হয়?”
ব্রজসুন্দরী বলিল, “দ্বারবান কে?”
কা। আমরা দুইজন।
ব্র। কত ভাগ চাও?
কামিনী। পেয়েছ কি?
ব্র। দশটি টাকা।
কা। তবে, আমাদের আট টাকা আট টাকা ষোল টাকা দিয়া যাও।
ব্র। লাভ মন্দ নয়!
কা। তা বড় মানুষের বাড়ীর ভিক্ষায় লাভালাভ ধরিতে গেলে চলিবে কেন? সময়ে অসময়ে ঘর থেকেও কিছু দিতে হয়।
ব্রজসুন্দরী বড় মানুষের স্ত্রী। ধাঁ করিয়া ষোল টাকা বাহির করিয়া দিল। আমরা সেই ষোল টাকা যমুনা ঠাকুরাণীকে দিলাম, বলিলাম, “তোমরা এই টাকায় সন্দেশ খাইও।”
স্বামী বলিলেন, “ব্যাপার কি?”
ততক্ষণে ব্রজসুন্দরী ছেলে পাঠাইয়া দিয়া, বানারসী পরিয়া আসিয়া বসিলেন। আবার একটা হাসির ঘটা পড়িয়া গেল।
উ-বাবু বলিলেন, “এ কি যাত্রা নাকি?”
যমুনা বলিল, “তা না ত কি? দেখিতেছ না, কাহারও কালিয়দমনের পালা, কারও কলঙ্কভঞ্জনের পালা, কারও মাথুর মিলন,--কারও শুধু পালাই পালাই পালা।”
উ-বাবু। শুধু পালাই পালাই পালা কার?
য। কেন কামিনীর! কেবল পালাই পালাই তার পালা।