বিংশ পরিচ্ছেদ : বিদ্যাধরীর অন্তর্দ্ধান

এইরূপ কথাবার্তা হইলে পর আমরা যথাকালে উভয়ে কলিকাতা হইতে যাত্রা করিলাম। তিনি আমাকে কালাদীঘি নামক সেই হতভাগ্য দীঘি পার করিয়া নিজালয়ের অভিমুখে যাত্রা করিলেন।

সঙ্গের লোকজন আমাকে মহেশপুর লইয়া গেল। গ্রামের বাহিরে বাহক ও রক্ষকদিগকে অবস্থিতি করিতে বলিয়া দিয়া আমি পদব্রজে গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। সম্মুখেই পিতাকে দেখিয়া প্রণাম করিলাম। তিনি আমাকে চিনিতে পারিয়া আহ্লাদে বিবশ হইলেন। সেসকল কথা এস্থানে বলিবার অবসর নাই।

আমি এত দিন কোথায় ছিলাম, কি প্রকারে আসিলাম—তাহা কিছুই বলিলাম না। পিতামাতা জিজ্ঞাসা করিলে বলিলাম, “এর পরে বলিব।”

সময়ান্তরে স্থূল কথা তাঁহাদিগকে বলিলাম, কিন্তু সব কথা নহে। এতটুকু বুঝিতে দিলাম যে, পরিশেষে আমি স্বামীর নিকটেই ছিলাম এবং স্বামীর নিকট হইতেই আসিয়াছি। এবং তিনিও দুই একদিনের মধ্যে এখানে আসিবেন। সব কথা ভাঙ্গিয়া চুরিয়া কামিনীকে বলিলাম। কামিনী আমার অপেক্ষা দুই বৎসরের ছোট। বড় রঙ্গ ভালবাসে। সে বলিল, “দিদি! যখন মিত্রজা এত বড় গোবরগণেশ, তাকে নিয়া একটু রঙ্গ করিলে হয় না?” আমি বলিলাম, “আমারও সেই ইচ্ছা।” তখন দুই বহিনে পরামর্শ আঁটিলাম। সকলকে শিখাইয়া ঠিক করিলাম। বাপ-মাকেও একটু শিখাইতে হইল। কামিনী তাঁহাদিগকে বুঝাইল যে, প্রকাশ্যে গ্রহণ করাটা এখনও হয় নাই। সেটা এইখানে হইবে। আমরাই তাহা করিয়া লইব। তবে আমি যে এখানে আসিয়াছি, এই কথাটা তাঁহারা, জামাতা আসিলে তাঁহার সাক্ষাতে প্রকাশ না করেন।

পরদিন, সে জামাতা আসিলেন। পিতামাতা তাঁহাকে যথেষ্ট আদর-অপেক্ষা করিলেন। আমি আসিয়াছি, এ কথা বাহিরে কাহারও মুখে তিনি শুনিলেন না। কাহাকেও জিজ্ঞাসা করিতে পারিলেন না। যখন অন্ত:পুরে জলযোগ করিতে আসিলেন, তখন বড় বিষণ্ণবদন।

জলযোগের সময়, আমি সম্মুখে রহিলাম না। কামিনী বসিল, আর দুই চারি জন জ্ঞাতি ভগিনী ভাইজ বসিল। তখন সন্ধ্যাকাল উত্তীর্ণ হইয়াছে। কামিনী অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল; তিনি যেন কলে উত্তর দিতে লাগিলেন। আমি আড়ালে দাঁড়াইয়া সব শুনিতে দেখিতে লাগিলাম। পরিশেষে তিনি কামিনীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার দিদি কোথায়?”

কামিনী খুব একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “কি জানি কোথায়? কালাদীঘিতে সেই যে সর্বনাশটা হইয়া গেল, তার পর ত আর কোন খবর পাওয়া যায় নাই।”

তাঁর মুখখানা বড় লম্বা হইয়া গেল। কথা আর কহিতে পারেন না। বুঝি কুমুদিনীকে হারাইলাম, এ কথা মনে করিয়া থাকিবেন; কেন না, তাঁর চক্ষু দিয়া দরবিগলিত ধারা বহিতে লাগিল।

চক্ষের জল সামলাইয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “কুমুদিনী বলিয়া, কোন স্ত্রীলোক আসিয়াছিল কি?”