ইন্দিরা
যমুনা ঠাকুরাণী “মহিষী” শব্দের অর্থবোধে যেমন পণ্ডিতা, “পুলিন” শব্দের অর্থবোধেও সেইরূপ। তিনি ভাবিলেন, আমি বুঝি কোন পুলিনবিহারীর কথার ইঙ্গিত করিয়া তাঁহার অকলঙ্কিত সতীত্বের-(অকলঙ্কিত তাঁহার রূপের প্রভাবে)—প্রতি কোনপ্রকার ইঙ্গিত করিয়াছি। তিনি সক্রোধে বলিলেন, “এর ভিতর পুলিন কে লো?”
কাজেই আমারও একটু রঙ্গ চড়াইতে ইচ্ছা হইল। আমি বলিলাম, “যার গায়ে পড়িয়া যমুনা রাত্রিদিন তরঙ্গভঙ্গ করে, বৃন্দাবন তাকে পুলিন বলে।”
আবার তরঙ্গভঙ্গে সর্বনাশ করিল,--যমুনা দিদি ত কিছু বুঝিল না, রাগিয়া বলিল, “তোর তরঙ্গ ফরঙ্গকেও চিনি নে, তোর পুলিনকেও চিনি নে, তোর বেন্দাবনকে চিনি নে। তুই বুঝি ডাকাতের কাছে এত সব রঙ্গরসের নাম শিখে এসেছিস?”
মজলিসের ভিতর রঙ্গময়ী বলিয়া আমার একজন সমবয়স্কা ছিল। সে বলিল, “অত ক্ষেপ কেন যমুনা দিদি! পুলিন বলে নদীর ধারের চড়াকে। তোমার দু ধারে কি চড়া আছে?”
চঞ্চলা নামে যমুনা দিদির ভাইজ, ঘোমটা দিয়া পিছনে বসিয়াছিল, সে ঘোমটার ভিতর হইতে মৃদু মধুর স্বরে বলিল, “চড়া থাকিলেও বাঁচিতাম! একটু ফরসা কিছু দেখিতে পাইতাম। এখন কেবল কালো জলের কালিন্দী কল কল করিতেছে।”
কামিনী বলিল, “আমার যমুনা দিদিকে কেন তোরা অমন করে চড়ার মাঝখানে ফেলে দিতেছিস!”
চঞ্চলা বলিল, “বালাই! ষাট! ঠাকুরঝিকে চড়ার মাঝখানে ফেলে দেব কেন? ওঁর ভাইয়ের পায়ে ধরে বলব, যেন ঠাকুরঝিকে মেঠো শ্মশানে দেন।”
রঙ্গময়ী বলিল, “দুটোতে তফাৎ কি বৌ?”
চঞ্চলা বলিল, “শ্মশানে শিয়াল কুকুরের উপকার;--চড়ায় গোরু মহিষচরে—তাদের কি উপকার?” মহিষ কথাটা বলিবার সময়ে, বৌ একবার ঘোমটা তুলিয়া ননদের উপর সহাস্যে কটাক্ষ করিল।
যমুনা বলিল, “নে, আর এক-শবার সেই কথা ভাল লাগে না। যদের মোষ ভাল লাগে, তারাই এক-শবার মোষ মোষ করুগ গে।”
পিয়ারী ঠানদিদি কথাটায় বড় কাণ দেন নাই—তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “মোষের কথা কি গা?” কামিনী বলিল, “কোন্ দেশে তেলিদের বাড়ী মোষে ঘানি টানে, সেই কথা হ’চ্ছে।”
এই বলিয়া কামিনী পলাইল। বার বার সেই তেলি কথাটা মনে করিয়া দেওয়াটা ভাল হয় নাই—কিন্তু কামিনী কুচরিত্রা লোক দেখিতে পারিত না। পিয়ারী ঠানদিদি, রাগে অন্ধকার দেখিয়া আর কথা না কহিয়া উ-বাবুর কাছে গিয়া বসিল। আমি তখন কামিনীকে ডাকিয়া বলিলাম, “কামিনী! দেখসে আয় লো! এইবার পিয়ারী কৃষ্ণ পেয়েছেন।”
কামিনী দূর হইতেই বলিল, “অনেকদিন সময় হয়েছে।”
তার পর একটা সোরগোল শুনিলাম। আমার স্বামীর আওয়াজ শুনিতে পাইলাম—তিনি একজনকে হিন্দিতে ধমকধামক করিতেছেন। আমরা দেখিতে গেলাম। দেখিলাম, একজন দাড়িওয়ালা মোগল ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াছে; উ-বাবু তাহাকে তাড়াইবার জন্য ধমকধামক করিতেছেন, মোগল যাইতেছে না। কামিনী তখন দ্বার হইতে ডাকিয়া বলিল, “মিত্র মহাশয়! গায়ে কি জোর নেই?”
মিত্র মহাশয় বলিলেন, “আছে বই কি?”
কামিনী বলিল, “তবে মোগল মিন্সেকে গলা ধাক্কা দিয়া ঠেলিয়া দাও না।”