কামিনী কথায় সকলকে জ্বালাইতে লাগিল; পান, পুষ্প, আতর বিলাইয়া সকলকে তুষ্ট করিতেছিল। তখন সকলে মিলিয়া তাহাকে ধরিল, বলিল, “তুই যে বড় পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস লা?”

কামিনী বলিল, “পালাব না ত কি তোমাদের ভয় করি না কি?”

মিত্র মহাশয় বলিলেন, “কামিনী! ভাই, তোমার সঙ্গে কি কথা ছিল?”

কা। কি কথা ছিল, মিত্র মহাশয়?

উ-বাবু। তুমি নাচিবে।

কা। আমি ত নেচেছি।

উ। কখন নাচলে?

কা। দুপুরবেলা।

উ। কোথায় নাচলি লো?

কা। আমার ঘরের ভিতর, দোর বন্ধ করে।

উ। কে দেখেছে?

কা। কেউ না।

উ। তেমনতর ত কথা ছিল না।

কা। এমন কথাও ছিল না যে, তোমাদের সমুখে আসিয়া পেশওয়াজ পরিয়া নাচিব। নাচিব স্বীকার করিয়াছিলাম, তা নাচিয়াছি। আমার কথা রাখিয়াছি। তোমরা দেখিতে পাইলে না, তোমাদের অদৃষ্টের দোষ। এখন আমি যে শিকল কিনিয়া রাখিয়াছি, তার কি হবে?

কামিনী যদি নাচের দায়ে এড়াইল, তবে আমার স্বামী গানের জন্য ধরা পড়িলেন। মজলিস হইতে হুকুম হইল, তোমাকে গায়িতে হইবে। তিনি পশ্চিমাঞ্চলে রীতিমত গীতবিদ্যা শিখিয়াছিলেন। তিনি সনদী খিয়াল গায়িলেন। শুনিয়া সে অপ্সরোমণ্ডলী হাসিল। ফরমায়েস করিল, “বদন অধিকারী, কি দাশু রায়।” তাতে উ-বাবু অপটু। সুতরাং অপ্সরোগণ সন্তুষ্ট হইল না।

এইরূপে দুই প্রহর রাত্রি কাটিল। এ পরিচ্ছেদটা না লিখিলেও লিখিলেও পারিতাম। তবে এ দেশের গ্রাম্য স্ত্রীদিগের জীবনের এই ভাগটুকু এখন লোপ পাইয়াছে বলিয়া আমার বিশ্বাস। লোপ পাইয়াছে, ভালই হইয়াছে; কেন না, ইহার সঙ্গে অশ্লীলতা, নির্লজ্জতা, কদাচিৎ বা দুর্নীতি, আসিয়া মিশিত। কিন্তু যাহা লোপ পাইয়াছে, তাহার একটি চিত্র দিবার বাসনায়, এই পরিচ্ছেদটা লিখিলাম। তবে জানি না, অনেক স্থানে এ কুরীতি লোপ না পাইয়াও থাকিতে পারে। যদি তাহা হয়, তবে যাঁহারা জামাই দেখিতে পৌরস্ত্রীদিগকে যাইতে নিষেধ করেন না, তাঁহাদের চোখ কাণ ফুটাইয়া দেওয়া প্রয়োজনীয়। তাই ধরি মাছ, না ছুঁই পানি করিয়া, তাঁহাদের ইঙ্গিত করিলাম।