দ্বাবিংশতিতম পরিচ্ছেদ : উপসংহার

আমি পরদিন স্বামীর সঙ্গে শিবিকারোহণে শ্বশুরবাড়ী গেলাম। স্বামীর সঙ্গে যাইতেছি, সে একটা সুখ বটে, কিন্তু সেবার যে যাইতেছিলাম, সে আর একপ্রকারের সুখ। যাহা কখন পাই নাই, তাই পাইবার আশায় যাইতেছিলাম; এখন যাহা পাইয়াছিলাম, তাই আঁচলে বাঁধিয়া লইয়া যাইতেছিলাম। একটা কবির কাব্য, অপরটা ধনীর ধন। ধনীর ধন কবির কাব্যের সমান কি? যাহারা ধনোপার্জন করিয়া বুড়া হইয়াছে, কাব্য হারাইয়াছে, তাহারাও একথা বলে না। তাহারা বলে, ফুল যতক্ষণ গাছে ফুটে, ততক্ষণই সুন্দর; তুলিলে আর তেমন সুন্দর থাকে না। স্বপ্ন যেমন সুখের, স্বপ্নের সফলতা কি তত সুখের হয়? আকাশ যেমন বস্তুত: নীল হয়, আমরা নীল দেখি মাত্র, ধন তেমনই। ধন সুখের নয়, আমরা সুখের বলিয়া মনে করি। কাব্যই সুখ। কেন না, কাব্য আশা, ধন ভোগমাত্র। তাও সকলের কপালে নয়। অনেক ধনী লোক কেবল ধনাগারের প্রহরী মাত্র। আমার একজন কুটম্ব বলেন, “ত্রেজুরি গার্ড।”

তবু সুখে সুখেই শ্বশুরবাড়ী চলিলাম। সেখানে, এবার নির্বিঘ্নে পৌঁছিলাম। স্বামী মহাশয়, মাতাপিতার সমীপে সমস্ত কথা সবিশেষ নিবেদন করিলেন। রমণ বাবুর পুলিন্দা খোলা হইল। তাঁহার কথার সঙ্গে আমার সকল কথা মিলিল। আমার শ্বশুর শাশুড়ী সন্তুষ্ট হইলেন। সমাজের লোকেও সবিশেষ বৃত্তান্ত জানিতে পারিয়া, কোন কথা তুলিল না।

আমি সকল ঘটনা বিবৃত করিয়া, সুভাষিণীকে পত্র লিখিলাম। সুভাষিণীর জন্য সর্বদা আমার প্রাণ কাঁদিত। আমার স্বামী আমার অনুরোধে রমণ বাবুর নিকট হারাণীর জন্য পাঁচ শত টাকা পাঠাইয়া দিলেন। শীঘ্রই সুভাষিণীর উত্তর পাইলাম। উত্তর আনন্দ-পরিপূর্ণ। সুভাষিণী, র-বাবুর হস্তাক্ষরে পত্র লিখিয়াছিল। কিন্তু কথাগুলা সুভাষিণীর নিজের, তাহা কথার রকমেই বুঝা গেল। সে সকলেরই সংবাদ লিখিয়াছিল। দুই একটা সংবাদ উদ্ধৃত করিতেছি। সে লিখিতেছে,

“হারাণী প্রথমে কিছুতেই টাকা লইবে না। বলে, আমার লোভ বাড়িয়া যাইবে। এটা যেন ভাল কাজই করিয়াছিলাম, কিন্তু এ রকম কাজ ত মন্দই হয়। আমি যদি লোভে পড়িয়া মন্দেই রাজি হই? আমি পোড়ারমুখীকে বুঝাইলাম যে, আমার ঝাঁটা না খাইলে কি তুই এ কাজ করিতিস? সবার বেলাই কি তুই আমার হাতের ঝাঁটা খেতে পাবি? মন্দ কাজের বেলা কি আমি তোকে তেমনই তোর সুধু মুখে ঝাঁটা খাওয়াইব? দুটো গালাগালিও খাবি না কি? ভাল কাজ করেছিলি, বখশিশ নে। এইরূপ অনেক বুঝান পড়ানতে সে টাকা নিয়াছে। এখন নানারকম ব্রত নিয়ম করিবার ফর্দ করিতেছে। যতদিন না তোমার এই সংবাদ পাওয়া গিয়াছিল, ততদিন সে আর হাসে নাই, কিন্তু এখন তার হাসির জ্বালায় বাড়ীর লোক অস্থির হইয়াছে।”

পাচিকা ব্রাহ্মণ ঠাকুরাণীর সংবাদ সুভাষিণী এইরূপ লিখিল, “যে অবধি তুমি তোমার স্বামীর সঙ্গে গোপনে চলিয়া গিয়াছ, সে অবধি বুড়ী বড় আস্ফালন করিত, বলিত, ‘আমি বরাবর জানি, সে মানুষ ভাল নয়। তার রকমসকম ভাল নয়। কত বার বলেছি যে, এমন কুচরিত্র মানুষ তোমরা রেখ না। তা, কাঙ্গালের কথা কে গ্রাহ্য করে? সবাই কুমুদিনী কুমুদিনী করে অজ্ঞান।” এমনই এমনই আরও কথা। তার পর যখন শুনিল যে, তুমি কাহারও সঙ্গে যাও নাই, আপনার স্বামীর সঙ্গে গিয়াছ, তুমি বড়মানুষের মেয়ে, বড়মানুষের বৌ—এখন আপনার ঘর বর পাইয়াছ, তখন বলিল, ‘আমি ত বরাবর বলচি মা যে, সে বড় ঘরের মেয়ে, ছোট ঘরে কি আর অমন স্বভাব চরিত্র হয়? যেমন রূপ, তেমনই গুণ, যেন লক্ষ্মী! সে ভাল থাকুক মা! ভাল থাকুক! তা, হা দেখ বৌদিদি! আমাকে কিছু পাঠাইয়া দিতে বল’|”