স্থূল কথা, এই সকল মজলিসগুরলায় অনেক নির্লজ্জ ব্যাপার ‌ঘটিয়া থাকে জানিতাম। তাই কামিনী আর আমি গেলাম না—বাহিরে রহিলাম। দ্বার হইতে মধ্য মধ্যে উঁকি মারিতে লাগিলাম। যদি বল, যাহাতে নির্লজ্জ ব্যাপার ঘটে, তুমি তাহার বর্ণনায় কে‍ন প্রবৃত্ত, তাহাতে আমার উত্তর এই যে, আমি হিন্দুর মেয়ে, আমার রুচিতে এই সকল ব্যাপার নির্লজ্জ ব্যাপার। কিন্তু এখনকার প্রচলিত রুচি ইংরেজি রুচি; ইংরেজি রুচির বিধানমতে বিচার করিলে ইহাতে নির্লজ্জ ব্যাপার কিছুই পাওয়া যাইবে না।

বলিয়াছি, আমি ও কামিনী দুই জনে একবার একবার উঁকি মারিলাম। দেখি, পাড়ার যমুনাঠাকুরাণী সভাপত্নী হইয়া জমকাইয়া বসিয়া আছেন। তাঁর বয়স পঁয়তাল্লিশ ছাড়াইয়াছে; রঙটা মিঠেরকম কালো; চোখ দুইটা ছোট ছোট, কিন্তু একটু ঢুলু ঢুলু ঠোঁট দুইখানা পুরু, কিন্তু রসে ভরা ভরা। বস্ত্রালঙ্কারের বাহার–-পায়ে আলতার বাহার, কালোতে রাঙা যেন যমুনাতেই জবা,-মাথায় ছেঁড়া চুলের বাহার। শরীরের ব্যাস ও পরিধি অসাধারণ দেখিয়া, আমার স্বামী তাঁহাকে “নদীরূপা মহিষী” বলিয়া ব্যঙ্গ করিতেছেন। মথুরাবাসীরা যমুনা নদীকে কৃষ্ণের নদীরূপা মহিষী বলিয়া থাকে, সেই কথা লক্ষ্য করিয়া উ-বাবু এই রসিকতা করিলেন। এখন আমার যমুনা দিদি কখনও মথুরা যান নাই, এত খবরও জানেন না, এবং মহিষী শব্দের অর্থটা জানেন না। তিনি মহিষী অর্থ কেবল মাদি মহিষই বুঝিয়াছিলেন এবং সেই জন্তুর সহিত আপনার শরীরের সাদৃশ্য লক্ষ্য করিয়া রাগে গর গর করিতেছিলেন। প্রতিশোধার্থ তিনি আমার স্বামীর সম্মুখে আমাকে প্রকারান্তরে “গাই” বলিলেন, এমন সময়ে আমি দ্বার হইতে মুখ বাড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “যমুনা দিদি! কি গা?”

যমুনা দিদি বলিলেন, “একটা গাই ভাই।”

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “গাই কেন গা?”

কামিনী আমার পাশ হইতে বলিল, “ডেকে ডেকে যমুনা দিদির গলা কাঠ হইয়া গিয়াছে। একবার পিওবে।”

হাসির চোটে সভাপত্নী মহাশয়া নিবিয়া গেলেন, কামিনীর উপর গরম হইয়া বলিলেন, “একরত্তি মেয়ে, তুই সকল হাঁড়িতে কাটি দিস কেন্ লো কামিনি?”

কামিনী বলিল, “আর ত কেউ তোমার ভুসি কলাই সিদ্ধ করতে জানে না।”

এই বলিয়া কামিনী পলাইল, আমিও পলাইলাম। আবার একবার গিয়া উঁকি মারিলাম, দেখি, পাড়ার পিয়ারী ঠান‍দিদি, জাতিতে বৈদ্য—বয়স পঞ্চষষ্টি বৎসর, তার মধ্যে পঞ্চবিংশতি বৎসর বৈধব্যে কাটিয়াছে—তিনি সর্বাঙ্গে অলঙ্কার পরিয়া ঘাঘরা পরিয়া, রাধিকা সাজিয়া আসিয়াছেন। আমার স্বামীকে লক্ষ্য করিয়া কৃষ্ণ কৈ? কৃষ্ণ কৈ? বলিয়া সেই কামিনীকুঞ্জবন পরিভ্রমণ করিতেছেন।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি খোঁজ ঠান্ক‍দিদি?”

তিনি বলিলেন, “আমি কৃষ্ণকে খুঁজি।”

কামিনী বলিল, “গোয়ালবাড়ী যাও—এ কায়েতের বাড়ী।”

রসিকতাপ্রবীণা বলিল, “কায়েতের বাড়ীই আমার কৃষ্ণ মিলিবে।”

কামিনী বলিল, “ঠান‍‍দিদি, সকল জাতেই জাত দিয়াছ নাকি?”

এখন পিয়ারী ঠাকুরাণীর এককালে তেলি অপবাদ ছিল। এই কথায়, তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলিয়া উঠিয়া কামিনীকে ব্যঙ্গচ্ছলে গালি পাড়িতে আরম্ভ করিলেন। আমি তাঁকে থামাইবার জন্য, যমুনা দিদিকে দেখাইয়া দিয়া বলিলাম, “রাগ কর কেন? তোমার কৃষ্ণ ঐ যমুনায় ঝাঁপ দিয়াছেন। এসো—তোমায় আমায় পুলিনে দাঁড়াইয়া একটু কাঁদি।”