কপালকুণ্ডলা
“আপনি কখনও কি স্ত্রীলোক দেখেন নাই, না আপনি আমাকে বড় সুন্দরী মনে করিতেছেন?”
সহজে এ কথা কহিলে, তিরস্কারস্বরূপ বোধ হইত, কিন্তু রমণী যে হাসির সহিত বলিলেন, তাহাতে ব্যঙ্গ ব্যতীত আর কিছুই বোধ হইল না। নবকুমার দেখিলেন, এ অতি মুখরা; মুখরার কথায় কেন না উত্তর করিবেন? কহিলেন,
“আমি স্ত্রীলোক দেখিয়াছি; কিন্তু এরূপ সুন্দরী দেখি নাই |”
রমণী সগর্বে জিজ্ঞাসা করিলেন, “একটিও না?”
নবকুমারের হৃদয়ে কপালকুণ্ডলার রূপ জাগিতেছিল; তিনিও সগর্বে উত্তর করিলেন, একটিও না, এমত বলিতে পারি না |”
উত্তরকারিণী কহিলেন, “তবুও ভাল। সেটি কি আপনার গৃহিণী?”
ন। কেন? গৃহিণী কেন মনে ভাবিতেছ?
স্ত্রী। বাঙ্গালীরা আপন গৃহিণীকে সর্বাপেক্ষা সুন্দরী দেখে।
ন। আমি বাঙ্গালী; আপনিও ত বাঙ্গালীর ন্যায় কথা কহিতেছেন, আপনি তবে কোন্ দেশীয়?
যুবতী আপন পরিচ্ছদের প্রতি দৃষ্টি করিয়া কহিলেন, “অভাগিনী বাঙ্গালী নহে; পশ্চিমপ্রদেশীয়া মুসলমানী |” নবকুমার পর্যবেক্ষণ করিয়া দেখিলেন, পরিচ্ছদ পশ্চিমপ্রদেশীয়া মুসলমানীর ন্যায় বটে। কিন্তু বাঙ্গালা ত ঠিক বাঙ্গালীর মতই বলিতেছে। ক্ষণপরে তরুণী বলিতে লাগিলেন,
“মহাশয় বাগ্বৈদগ্ধ্যে আমার পরিচয় লইলেন–আপনি পরিচয় দিয়া চরিতার্থ করুন। যে গৃহে সেই অদ্বিতীয়া রূপসী গৃহিণী, সে গৃহ কোথায়?”
নবকুমার কহিলেন, “আমার নিবাস সপ্তগ্রাম |”
বিদেশিনী কোন উত্তর করিলেন না। সহসা তিনি মুখাবনত করিয়া, প্রদীপ উজ্জ্বল করিতে লাগিলেন।
ক্ষণেক পরে মুখ তুলিয়া বলিলেন, “দাসীর নাম মতি। মহাশয়ের নাম কি শুনিতে পাই না?”
নবকুমার বলিলেন, “নবকুমার শর্মা |”
প্রদীপ নিবিয়া গেল।