কপালকুণ্ডলা
নবকুমার কহিলেন, “কাঁদিব কেন? তুমি কি জানিবে মৃণ্ময়ী! তুমি ত কখন রূপ দেখিয়া উন্মত্ত হও নাই__” বলিতে বলিতে নবকুমারের কণ্ঠস্বর যাতনায় রুদ্ধ হইয়া আসিতে লাগিল। “তুমি ত কখনও আপনার হৃৎপিণ্ড আপনি ছেদন করিয়া শ্মশানে ফেলিতে আইস নাই |” এই বলিয়া সহসা নবকুমার চীৎকার করিয়া রোদন করিতে করিতে কপালকুণ্ডলার পদতলে আছড়াইয়া পড়িলেন।
“মৃণ্ময়ী!–কপালকুণ্ডলে! আমায় রক্ষা কর। এই তোমার পায়ে লুটাইতেছি–একবার বল যে, তুমি অবিশ্বাসিনী নও–একবার বল, আমি তোমার হৃদয়ে তুলিয়া গৃহে লইয়া যাই |”
কপালকুণ্ডলা হাত ধরিয়া নবকুমারকে উঠাইলেন–মৃদু স্বরে কহিলেন, “তুমি ত জিজ্ঞাসা কর নাই!”
যখন এই কথা হইল, তখন উভয়ে একেবারে জলের ধারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন; কপালকুণ্ডলা অগ্রে, নদীর দিকে পশ্চাৎ করিয়া ছিলেন, তাঁহার পশ্চাতে এক পদ পরেই জল। এখন জলোচ্ছ্বাস আরম্ভ হইয়াছিল, কপালকুণ্ডলা একটা আড়রির উপর দাঁড়াইয়া ছিলেন। তিনি উত্তর করিলেন, “তুমি ত জিজ্ঞাসা কর নাই!”
নবকুমার ক্ষিপ্তের ন্যায় কহিলেন, “চৈতন্য হারাইয়াছি, কি জিজ্ঞাসা করিব–বল–মৃণ্ময়ী! বল–বল–বল–আমায় রাখ।-গৃহে চল |”
কপালকুণ্ডলা কহিলেন, “যাহা জিজ্ঞাসা করিলে বলিব। আজি যাহাকে দেখিয়াছ,-সে পদ্মাবতী। আমি অবিশ্বাসিনী নহি। এ কথা স্বরূপ বলিলাম। কিন্তু আর আমি গৃহে যাইব না। ভবানীর চরণে দেহ বিসর্জন করিতে আসিয়াছি–নিশ্চিত তাহা করিব। তুমি গৃহে যাও। আমি মরিব। আমার জন্য রোদন করিও না |”
“না মৃণ্ময়ী না! __” এইরূপ উচ্চ শব্দ করিয়া নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে হৃদয়ে ধারণ করিতে বাহু প্রসারণ করিলেন। কপালকুণ্ডলাকে আর পাইলেন না। চৈত্রবায়ুতাড়িত এক বিশাল তরঙ্গ আসিয়া, তীরে যথায় কপালকুণ্ডলা দাঁড়াইয়া, তথায় তটাধোভাগে প্রহত হইল; অমনি তটমৃত্তিকাখণ্ড কপালকুণ্ডলা সহিত ঘোর রবে নদীপ্রবাহমধ্যে ভগ্ন হইয়া পড়িল। নবকুমার তীরভঙ্গের শব্দ শুনিলেন, কপালকুণ্ডলা অন্তর্হিত হইল দেখিলেন। অমনি তৎপশ্চাৎ লম্ফ দিয়া জলে পড়িলেন। নবকুমার সন্তরণে নিতান্ত অক্ষম ছিলেন না। কিছুক্ষণ সাঁতার দিয়া কপালকুণ্ডলার অণ্বেষণ করিতে লাগিলেন। তাঁহাকে পাইলেন না, তিনিও উঠিলেন না।
সেই অনন্ত গঙ্গাপ্রবাহমধ্যে, বসন্তবায়ুবিক্ষিপ্ত বীচিমালায় আন্দোলিত হইতে হইতে কপালকুণ্ডলা ও নবকুমার কোথায় গেল?