তৃতীয় পরিচ্ছেদ : সুন্দরীসন্দর্শনে

_______ধর দেবি মোহন মূরতি

দেহ আজ্ঞা, সাজাই ও বরবপু আনি

নানা আভরণ!

                       মেঘনাদবধ

নবকুমার গৃহস্বামীকে ডাকিয়া অন্য প্রদীপ আনিতে বলিলেন। অন্য প্রদীপ আনিবার পূর্বে একটি দীর্ঘনিশ্বাসশব্দ শুনিতে পাইলেন। প্রদীপ আনিবার ক্ষণেক পরে ভৃত্যবেশী একজন মুসলমান আসিয়া উপস্থিত হইল। বিদেশিনী তাহাকে দেখিয়া কহিলেন, “সে কি, তোমাদিগের এত বিলম্ব কেন? আর সকলে কোথায়?”

ভৃত্য কহিল, “বাহকেরা মাতোয়ারা হইয়াছিল, তাহাদের গুছাইয়া আনিতে আমরা পাল্কীর পশ্চাতে পড়িয়াছিলাম। পরে ভগ্ন শিবিকা দেখিয়া এবং আপনাকে না দেখিয়া আমরা একেবারে অজ্ঞান হইয়াছিলাম। কেহ কেহ সেই স্থানে আছে; কেহ কেহ অন্যান্য দিকে আপনার সন্ধানে গিয়াছে। আমি এদিকে সন্ধানে

আসিয়াছি |”

মতি কহিলেন, “তাহাদিগকে লইয়া আইস |”

নফর সেলাম করিয়া চলিয়া গেল, বিদেশিনী কিয়ৎকাল করলগ্নকপোলা হইয়া বসিয়া রহিলেন।

নবকুমার বিদায় চাহিলেন। তখন মতি স্বপ্নোত্থিতার ন্যায় গাত্রোত্থান করিয়া পূর্ববৎভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কোথায় অবস্থিতি করিবেন?”

ন। ইহারই পরের ঘরে।

ম। আপনার সে ঘরের কাছে একখানি পাল্কী দেখিলাম, আপনার কি কেহ

সঙ্গী আছেন?

“আমার স্ত্রী সঙ্গে |”

মতিবিবি আবার ব্যঙ্গের অবকাশ পাইলেন। কহিলেন, “তিনিই কি অদ্বিতীয়া রূপসী?”

ন। দেখিলে বুঝিতে পারিবেন।

ম। দেখা কি পাওয়া যায়?

ন। (চিন্তা করিয়া) ক্ষতি কি?

“তবে একটু অনুগ্রহ করুন। অদ্বিতীয়া রূপসীকে দেখিতে বড় কৌতূহল হইতেছে। আগরা গিয়া বলিতে চাহি, কিন্তু এখনই নহে–আপনি এখন যান। ক্ষণেক পরে আমি আপনাকে সংবাদ দিব |”

নবকুমার চলিয়া গেলেন। ক্ষণেক পরে অনেক লোকজন, দাসদাসী ও বাহক সিন্দুক ইত্যাদি লইয়া উপস্থিত হইল। একখানি শিবিকাও আসিল; তাহাতে একজন দাসী। পরে নবকুমারের নিকট সংবাদ আসিল, “বিবি স্মরণ করিয়াছেন |”

নবকুমার মতিবিবির নিকট পুনরাগমন করিলেন। দেখিলেন, এবার আবার রূপান্তর। মতিবিবি, পূর্বপরিচ্ছদ ত্যাগ করিয়া সুবর্ণমুক্তাদিশোভিত কারুকার্যযুক্ত বেশভূষা ধারণ করিয়াছেন; নিরলঙ্কার দেহ অলঙ্কারে খচিত করিয়াছেন। যেখানে যাহা ধরে–কুন্তলে, কবরীতে, কপালে, নয়নপার্শ্বে, কর্ণে, কণ্ঠে, হৃদয়ে, বাহুযুগে, সর্বত্র সুবর্ণমধ্য হইতে হীরকাদি রত্ন ঝলসিতেছে। নবকুমারের চক্ষু অস্থির হইল। প্রভূতনক্ষত্রমালাভূষিত আকাশের ন্যায়–মধুরায়ত শরীর সহিত অলঙ্কারবাহুল্য সুসঙ্গত বোধ হইল, এবং তাহাতে আরও সৌন্দর্য্যপ্রভা বর্দ্ধিত হইল। মতিবিবি নবকুমারকে বলিলেন, “মহাশয়, চলুন, আপনার পত্নীর নিকট পরিচিত করিয়া আসি”। নবকুমার বলিলেন, “সে জন্য অলঙ্কার পরিবার প্রয়োজন ছিল না। আমার পরিবারের কোন গহনাই নাই |”