কপালকুণ্ডলা
দ্বিতীয় খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ : রাজপথে
“-There-now lean on me:
Place your foot here”-
Manfred
নবকুমার মেদিনীপুরে আসিয়া অধিকারীর প্রদত্ত ধনবলে কপালকুণ্ডলার জন্য একজন দাসী, একজন রক্ষক ও শিবিকাবাহক নিযুক্ত করিয়া তাঁহাকে শিবিকারোহণে পাঠাইলেন। অর্থের অপ্রাচুর্য্য হেতু স্বয়ং পদব্রজে চলিলেন। নবকুমার পূর্বদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত ছিলেন, মধ্যাহ্নভোজনের পর বাহকেরা তাঁহাকে অনেক পশ্চাৎ করিয়া গেল। ক্রমে সন্ধ্যা হইল। শীতকালের অনিবিড় মেঘে আকাশ আচ্ছন্ন হইয়াছে। সন্ধ্যাও অতীত হইল। পৃথিবী অন্ধকারময়ী হইল। অল্প অল্প বৃষ্টিও পড়িতে লাগিল। নবকুমার কপালকুণ্ডলার সহিত একত্র হইবার জন্য ব্যস্ত হইলেন। মনে স্থির জ্ঞান ছিল যে, প্রথম সরাইতে তাঁহার সাক্ষাৎ পাইবেন, কিন্তু সরাইও আপাতত: দেখা যায় না। প্রায় রাত্রি চারি ছয় দণ্ড হইল। নবকুমার দ্রুতপাদবিক্ষেপ করিতে করিতে চলিলেন। অকস্মাৎ কোন কঠিন দ্রব্যে তাঁহার চরণস্পর্শ হইল। পদভরে সে বস্তু খড় খড় মড় মড় শব্দে ভাঙ্গিয়া গেল। নবকুমার দাঁড়াইলেন; পুনর্বার পদচালনা করিলেন; পুনর্বার ঐরূপ হইল। পদস্পৃষ্ট বস্তু হস্তে করিয়া তুলিয়া লইলেন। দেখিলেন, ঐ বস্তু তক্তাভাঙ্গার মত।
আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হইলেও সচরাচর এমত অন্ধকার হয় না যে, অনাবৃত স্থানে স্থূল বস্তুর অবয়ব লক্ষ্য হয় না। সম্মুখে একটা বৃহৎ বস্তু পড়িয়া ছিল; নবকুমার অনুভব করিয়া দেখিলেন যে, সে ভগ্ন শিবিকা, অমনি তাঁহার হৃদয়ে কপালকুণ্ডলার বিপদ আশঙ্কা হইল। শিবিকার দিকে যাইতে আবার ভিন্নপ্রকার পদার্থে তাঁহার পাদস্পর্শ হইল। এ স্পর্শ কোমল মনুষ্যশরীরস্পর্শের ন্যায় বোধ হইল। বসিয়া হাত বুলাইয়া দেখিলেন, মনুষ্যশরীর বটে। স্পর্শ অত্যন্ত শীতল; তৎসঙ্গে দ্রব পদার্থের স্পর্শ অনুভূত হইল। নাড়ীতে হাত দিয়া দেখিলেন, স্পন্দ নাই, প্রাণবিয়োগ হইয়াছে। বিশেষ মন:সংযোগ করিয়া দেখিলেন, যেন নিশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনা যাইতেছে। নিশ্বাস আছে, তবে নাড়ী নাই কেন? এ কি রোগী? নাসিকার নিকট হাত দিয়া দেখিলেন, নিশ্বাস বহিতেছে না। তবে শব্দ কেন? হয়ত কোন জীবিত ব্যক্তিও এখানে আছে, এই ভাবিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখানে কেহ জীবিত ব্যক্তি আছে?”
মৃদুস্বরে এক উত্তর হইল, “আছি |”
নবকুমার কহিলেন, “কে তুমি?”
উত্তর হইল, “তুমি কে?” নবকুমারের কর্ণে স্বর স্ত্রীকণ্ঠজাত বোধ হইল। ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কপালকুণ্ডলা না কি?”
স্ত্রীলোক কহিল, “কপালকুণ্ডলা কে, তা জানি না –আমি পথিক, আপাতত: দস্যুহস্তে নিষ্কুণ্ডলা হইয়াছি |”
ব্যঙ্গ শুনিয়া নবকুমার ঈষৎ প্রসন্ন হইলেন। জিজ্ঞাসিলেন, “কি হইয়াছে?”
উত্তরকারিণী কহিলেন, “দস্যুতে আমার পাল্কী ভাঙ্গিয়া দিয়াছে, আমার একজন বাহককে মারিয়া ফেলিয়াছে; আর সকলে পলাইয়া গিয়াছে। দস্যুরা আমার অঙ্গের অলঙ্কার সকল লইয়া আমার পাল্কীতে বাঁধিয়া রাখিয়া গিয়াছে |”