কপালকুণ্ডলা
প্রথম খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ : সাগরসঙ্গমে
“Floating straight obedient to the stream.”
Comedy of Errors.
প্রায় দুই শত পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে এক দিন মাঘ মাসের রাত্রিশেষে একখানি যাত্রীর নৌকা গঙ্গাসাগর হইতে প্রত্যাগমন করিতেছিল। পর্তুগিস ও অন্যান্য নাবিকদস্যুদিগের ভয়ে যাত্রীর নৌকা দলবদ্ধ হইয়া যাতায়াত করাই তৎকালের প্রথা ছিল; কিন্তু এই নৌকারোহীরা সঙ্গিহীন। তাহার কারণ এই যে, রাত্রিশেষে ঘোরতর কুজ্ঝ টিকা দিগন্ত ব্যাপ্ত করিয়াছিল; নাবিকেরা দিঙ্রনিরুপণ করিতে না পারিয়া বহর হইতে দূরে পড়িয়াছিল। এক্ষণে কোন দিকে কোথায় যাইতেছে, তাহার কিছুই নিশ্চয়তা ছিল না। নৌকারোহিগণ অনেকেই নিদ্রা যাইতেছিলেন। একজন প্রাচীন এবং একজন যুবা পুরুষ, এই দুই জন মাত্র জাগ্রৎ অবস্থায় ছিলেন। প্রাচীন যুবকের সহিত কথোপকথন করিতেছিলেন। বারেক কথাবার্তা স্থগিত করিয়া বৃদ্ধ নাবিকদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মাঝি, আজ কত দূর যেতে পারবি?” মাঝি কিছু ইতস্তত: করিয়া বলিল, “বলিতে পারিলাম না |”
বৃদ্ধ ক্রুদ্ধ হইয়া মাঝিকে তিরস্কার করিতে লাগিলেন। যুবক কহিলেন, “মহাশয়, যাহা জগদীশ্বরের হাত, তাহা পণ্ডিতে বলিতে পারে না–ও মূর্খ কি প্রকারে বলিবে? আপনি ব্যস্ত হইবেন না |”
বৃদ্ধ উগ্রভাবে কহিলেন, “ব্যস্ত হব না? বল কি, বেটারা বিশ পঁচিশ বিঘার ধান কাটিয়া লইয়া গেল, ছেলেপিলে সম্বৎসর খাবে কি?”
এ সংবাদ তিনি সাগরে উপনীত হইলে পরে পশ্চাদাগত অন্য যাত্রীর মুখে পাইয়াছিলেন। যুবা কহিলেন, “আমি ত পূর্বেই বলিয়াছিলাম, মহাশয়ের বাটীতে অভিভাবক আর কেহ নাই–মহাশয়ের আসা ভাল হয় নাই |”
প্রাচীন পূর্ববৎ উগ্রভাবে কহিলেন, “আসব না? তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে। এখন পরকালের কর্ম করিব না ত কবে করিব?”
যুবা কহিলেন, “যদি শাস্ত্র বুঝিয়া থাকি, তবে তীর্থদর্শনে যেরূপ পরকালের কর্ম হয়, বাটী বসিয়াও সেরূপ হইতে পারে |”
বৃদ্ধ কহিলেন, “তবে তুমি এলে কেন?”
যুবা উত্তর করিলেন, “আমি ত আগেই বলিয়াছি যে, সমুদ্র দেখিব বড় সাধ ছিল, সেইজন্যই আসিয়াছি |” পরে অপেক্ষাকৃত মৃদু স্বরে কহিতে লাগিলেন, “আহা! কি দেখিলাম! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না।
“দূরাদয়শ্চক্রনিভস্য তন্বী
তমালতালীবনরাজিনীলা।
আভাতি বেলা লবণাম্বুরাশে-
র্ধারানিবদ্ধেব কলঙ্করেখা ||”
বৃদ্ধের শ্রুতি কবিতার প্রতি ছিল না নাবিকেরা পরস্পর যে কথোপকথন করিতেছিল, তাহাই একতানমনা হইয়া শুনিতেছিলেন।
একজন নাবিক অপরকে কহিতেছিল, “ও ভাই –এ ত বড় কাজটা খারাবি হলো–এখন কি বার-দরিয়ায় পড়লেম–কি কোন্ দেশে এলেম, তা যে বুঝিতে পারি না |”