গায়িকার বয়স ষোল বৎসর। ষোড়শী, খর্বাকৃতা এবং কৃষ্ণাঙ্গী। সে প্রকৃত কৃষ্ণবর্ণা। তাই বলিয়া তাহার গায়ে ভ্রমর আসিলে যে দেখা যাইত না, অথবা কালি মাখিলে জল মাখিয়াছে বোধ হইত, কিংবা জল মাখিলে কালি বোধ হইত, এমন নহে। যেরূপ কৃষ্ণবর্ণ আপনার ঘরে থাকিলে শ্যামবর্ণ বলি, পরের ঘরে হইলে পাতুরে কালো বলি, ইহার সেইরূপ কৃষ্ণবর্ণ। কিন্তু বর্ণ যেমন হউক না কেন, ভিখারিণী কুরূপা নহে। তাহার অঙ্গ পরিষ্কার, সুমার্জিত, চাকচিক্যবিশিষ্ট; মুখখানি প্রফুল্ল, চক্ষু দুটি বড়, চঞ্চল, হাস্যময়; লোচনতারা নিবিড়কৃষ্ণ, একটি তারার পার্শ্বে একটি তিল। ওষ্ঠাধর ক্ষুদ্র, রক্তপ্রভ, তদন্তরে অতি পরিষ্কার অমলশ্বেত, কুন্দকলিকাসন্নিভ দুই শ্রেণী দন্ত। কেশগুলি সূক্ষ্ম, গ্রীবার উপরে মোহিনী কবরী, তাহাতে যূথিকার মালা বেষ্টিত। যৌবনসঞ্চারে শরীরের গঠন সুন্দর হইয়াছিল, যেন কৃষ্ণপ্রস্তরে কোন শিল্পকার পুত্তল খোদিত করিয়াছিল। পরিচ্ছদ অতি সামান্য, কিন্তু পরিষ্কার- ধূলিকর্দমপরিপূর্ণ নহে। অঙ্গ একেবারে নিরাভরণ নহে, অথচ অলঙ্কারগুলি ভিখারীর যোগ্য বটে। প্রকোষ্ঠে পিত্তলের বলয়, গলায় কাষ্ঠের মালা, নাসিকায় ক্ষুদ্র তিলক, ভ্রূমধ্যে ক্ষুদ্র একটি চন্দনের টিপ। সে আজ্ঞামত পূর্ববৎ গায়িতে লাগিল-

“মথুরাবাসিনি, মধুরহাসিনি, শ্যামবিলাসিনি-রে।

কহ লো নাগরি, গেহ পরিহরি, কাহে বিবাসিনী-রে ||

বৃন্দাবনধন, গোপিনীমোহন, কাঁহে তু তেয়াগী-রে |

দেশ দেশ পর, সো শ্যামসুন্দর, ফিরে তুয়া লাগি-রে ||

বিকচ নলিনে, যমুনা-পুলিনে, বহুত পিয়াসা-রে |

চন্দ্রমাশালিনী, যা মধুযামিনী, না মিটল আশা-রে ||

সা নিশা সমরি, কহ লো সুন্দরী, কাঁহা মিলে দেখা-রে |

শুনি যাওয়ে চলি, বাজয়ি মুরলী, বনে বনে একা-রে ||”

গীত সমাপ্ত হইলে মৃণালিনী কহিলেন, “তুমি সুন্দর গাও। সই মণিমালিনী, ইহাকে কিছু দিলে ভাল হয়। একে কিছু দাও না?”

মণিমালিনী পুরস্কার আনিতে গেলেন, ইত্যবসরে মৃণালিনী বালিকাকে নিকটে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “শুন ভিখারিণি! তোমার নাম কি?”

ভি। আমার নাম গিরিজায়া।

মৃ। তোমার বাড়ী কোথায়?

গি। এই নগরেই থাকি।

মৃ। তুমি কি গীত গাইয়া দিনপাত কর?

গি। আর কিছুই ত জানি না।

মৃ। তুমি গীত সকল কোথায় পাও?

গি। যেখানে যা পাই তাই শিখি।

মৃ। এ গীতটি কোথায় শিখিলে?

গি। একটি বেণে আমাকে শিখাইয়াছে।

মৃ। সে বেণে কোথায় থাকে?

গি। এই নগরেই আছে।

মৃণালিনীর মুখ হর্ষোৎফুল্ল হইল- প্রাত:সূর্যকরস্পর্শে যেন পদ্ম ফুটিয়া উঠিল। কহিলেন, “বেণেতে বাণিজ্য করে- সে বণিক কিসের বাণিজ্য করে?”