মৃণালিনী
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : পিঞ্জরের বিহঙ্গী
লক্ষ্মণাবতী-নিবাসী হৃষীকেশ সম্পন্ন বা দরিদ্র ব্রাহ্মণ নহেন। তাঁহার বাসগৃহের বিলক্ষণ সৌষ্ঠব ছিল। তাঁহার অন্ত:পুরমধ্যে যথায় দুইটি তরুণী কক্ষপ্রাচীরে আলেখ্য লিখিতেছিলেন, তথায় পাঠক মহাশয়কে দাঁড়াইতে হইবে। উভয় রমণীই আত্মকর্মে সবিশেষ মনোভিনিবেশ করিয়াছিলেন, কিন্তু তন্নিবন্ধন পরস্পরের সহিত কথোপকথনের কোন বিঘ্ন জন্মিতেছিল না। সেই কথোপথনের মধ্যভাগ হইতে পাঠক মহাশয়কে শুনাইতে আরম্ভ করিব।
এক যুবতী অপরকে কহিলেন, “কেন, মৃণালিনি, কথার উত্তর দিস না কেন? আমি সেই রাজপুত্রটির কথা শুনিতে ভালবাসি |”
“সই মণিমালিনী! তোমার সুখের কথা বল, আমি আনন্দে শুনিব |”
মণিমালিনী কহিল, “আমার সুখের কথা শুনিতে শুনিতে আমিই জ্বালাতন হইয়াছি, তোমাকে কি শুনাইব?”
মৃ। তুমি শোন কার কাছে- তোমার স্বামীর কাছে?
ম। নহিলে আর কারও কাছে বড় শুনিতে পাই না। এই পদ্মটি কেমন আঁকিলাম দেখ দেখি?
মৃ। ভাল হইয়াও হয় নাই। জল হইতে পদ্ম অনেক ঊর্ধ্বে আছে, কিন্তু সরোবরে সেরূপ থাকে না; পদ্মের বোঁটা জলে লাগিয়া থাকে, চিত্রেও সেইরূপ হইবে। আর কয়েকটি পদ্মপত্র আঁক; নহিলে পদ্মের শোভা স্পষ্ট হয় না। আরও, পার যদি, উহার নিকট একটি রাজহাঁস আঁকিয়া দাও।
ম। হাঁস এখানে কি করিবে?
মৃ। তোমার স্বামীর মত পদ্মের কাছে সুখের কথা কহিবে।
ম। (হাসিয়া) দুই জনেই সুকণ্ঠ বটে। কিন্তু হাঁস লিখিব না। আমি সুখের কথা শুনিয়া শুনিয়া জ্বালাতন হইয়াছি।
মৃ। তবে একটি খঞ্জন আঁক।
ম। খঞ্জন আঁকিব না। খঞ্জন পাখা বাহির করিয়া উড়িয়া যাইবে। এ ত মৃণালিনী নহে যে, স্নেহ-শিকলে বাঁধিয়া রাখিব।
মৃ। খঞ্জন যদি এমনই দুষ্ট হয়, তবে মৃণালিনীকে যেমন পিঞ্জরে পুরিয়াছ, খঞ্জনকেও সেইরূপ করিও।
ম। আমরা মৃণালিনীকে পিঞ্জরে পুরি নাই- সে আপনি আসিয়া পিঞ্জরে ঢুকিয়াছে।
মৃ। সে মাধবাচার্যের গুণ।
ম। সখি, তুমি কতবার বলিয়াছ যে, মাধবাচার্যের সেই নিষ্ঠুর কাজের কথা সবিশেষ বলিবে। কিন্তু কই, আজও বলিলে না। কেন তুমি মাধবাচার্যের কথায় পিতৃগৃহ ত্যাগ করিয়া আসিলে?
মৃ। মাধবাচার্যের কথায় আসি নাই। মাধবাচার্যকে আমি চিনিতাম না। আমি ইচ্ছাপূর্বকও এখানে আসি নাই। একদিন সন্ধ্যার পর, আমার দাসী আমাকে এই আঙ্গটি দিল; এবং বলিল যে, যিনি এই আঙ্গটি দিয়াছেন, তিনি ফুলবাগানে অপেক্ষা করিতেছেন। আমি দেখিলাম যে, উহা হেমচন্দ্রের সঙ্কেতের আঙ্গটি। তাঁহার সাক্ষাতের অভিলাষ থাকিলে তিনি এই আঙ্গটি পাঠাইয়া দিতেন। আমাদিগের বাটীর পিছনেই বাগান ছিল। যমুনা হইতে শীতল বাতাস সেই বাগানে নাচিয়া বেড়াইত। তথায় তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইত।
মণিমালিনী কহিলেন, “ঐ কথাটি মনে পড়িলেও আমার বড় অসুখ হয়। তুমি কুমারী হইয়া কি প্রকারে পুরুষের সহিত গোপনে প্রণয় করিতে?”
মৃ। অসুখ কেন সখি- তিনি আমার স্বামী। তিনি ভিন্ন অন্য কেহ কখন আমার স্বামী হইবে না।