মৃণালিনী
চতুর্থ পরিচ্ছেদ : দূতী
লক্ষ্মণাবতী নগরীর প্রদেশান্তরে সর্বধন বণিকের বাটীতে হেমচন্দ্র অবস্থিতি করিতেছিলেন। বণিকের গৃহদ্বারে এক অশোকবৃক্ষ বিরাজ করিতেছিল; অপরাহ্নে তাহার তলে উপবেশন করিয়া, একটি কুসুমিত অশোকশাখা নিষ্প্রয়োজনে হেমচন্দ্র ছুরিকা দ্বারা খণ্ড খণ্ড করিতেছিলেন, এবং মুহুর্মুহু: পথপ্রতি দৃষ্টি করিতেছিলেন, যেন কাহারও প্রতীক্ষা করিতেছেন। যাহার প্রতীক্ষা করিতেছিলেন, সে আসিল না। ভৃত্য দিগ্বিজয় আসিল, হেমচন্দ্র দিগ্বিজয়কে কহিলেন, “দিগ্বিজয়, ভিখারিণী আজি এখনও আসিল না। আমি বড় ব্যস্ত হইয়াছি। তুমি একবার তাহার সন্ধানে যাও |”
“যে আজ্ঞে” বলিয়া দিগ্বিজয় গিরিজায়ার সন্ধানে চলিল। নগরীর রাজপথে গিরিজায়ার সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইল।
গিরিজায়া বলিল, “কেও দিব্বিজয়?” দিগ্বিজয় রাগ করিয়া কহিল, “আমার নাম দিগ্বিজয় |”
গি। ভাল দিগ্বিজয়- আজি কোন্ দিক জয় করিতে চলিয়াছ?
দি। তোমার দিক।
গি। আমি কি একটা দিক? তোমার দিগ্বিদিগ্জ্ঞা ন নাই।
দি। কেমন করিয়া থাকিবে- তুমি যে অন্ধকার। এখন চল, প্রভু তোমাকে ডাকিয়াছেন।
গি। কেন?
দি। তোমার সঙ্গে বুঝি আমার বিবাহ দিবেন।
গি। কেন তোমার কি মুখ-অগ্নি করিবার আর লোক জুটিল না।
দি। না। সে কাজ তোমাকেই করিতে হইবে। এখন চল।
গি। পরের জন্যেই মলেম। তবে চল।
এই বলিয়া গিরিজায়া দিগ্বিজয়ের সঙ্গে চলিলেন। দিগ্বিজয় অশোকতলস্থ হেমচন্দ্রকে দেখাইয়া দিয়া অন্যত্র গমন করিল। হেমচন্দ্র অন্যমনে মৃদু মৃদু গাইতেছিলেন,
“বিকচ নলিনে, যমুনা-পুলিনে, বহুত পিয়াসা রে___”
গিরিজায়া পশ্চাৎ হইতে গায়িল-
“চন্দ্রমাশালিনী, যা মধুযামিনী, না মিটল আশা রে |”
গিরিজায়াকে দেখিয়া হেমচন্দ্রের মুখ প্রফুল্ল হইল। কহিলেন, “কে গিরিজায়া! আশা কি মিটল?”
গি। কার আশা? আপনার না আমার?
হে। আমার আশা। তাহা হইলেই তোমার মিটিবে।
গি। আপনার আশা কি প্রকারে মিটিবে? লোকে বলে রাজা রাজ্ড়া র আশা কিছুতেই মিটে না।
হে। আমার অতি সামান্য আশা।
গি। যদি কখন মৃণালিনীর সাক্ষাৎ পাই, তবে এ কথা তাঁহার নিকট বলিব।
হেমচন্দ্র বিষণ্ণ হইলেন। কহিলেন, “তবে কি আজিও মৃণালিনীর সন্ধান পাও নাই? আজি কোন্ পাড়ায় গীত গাইতে গিয়াছিলে?”
গি। অনেক পাড়ায়-সে পরিচয় আপনার নিকট নিত্য নিত্য কি দিব? অন্য কথা বলুন।
হেমচন্দ্র নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, “বুঝিলাম বিধাতা বিমুখ। ভাল পুনর্বার কালি সন্ধানে যাইবে |”