চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : ধরা পড়িল

গোবিন্দপুরে দত্তদিগের বাড়ীতে যেন অন্ধকারে একটি ফুল ফুটিল। কমলমণির হাসিমুখ দেখিয়া সূর্যমুখীরও চক্ষের জল শুকাইল। কমলমণি বাড়ীতে পা দিয়াই সূর্যমুখীর চুলের গোছা লইয়া বসিয়া গেলেন। অনেক দিন সূর্যমুখী কেশরচনা করেন নাই। কমলমণি বলিলেন, “দুটো ফুল গুঁজিয়া দিব?” সূর্যমুখী তাঁহার গাল টিপিয়া ধরিলেন। “না! না!” বলিয়া কমলমণি লুকাইয়া দুইটা ফুল দিয়া দিলেন। লোক আসিলে বলিলেন, “দেখেছ, মাগী বুড়া বয়সে মাথায় ফুল পরে |”

আলোকময়ীর আলো নগেন্দ্রের মুখমণ্ডলের মেঘেও ঢাকা পড়িল না। নগেন্দ্রকে দেখিয়াই কমলমণি ঢিপ করিয়া প্রণাম করিল। নগেন্দ্র বলিলেন, “কমল কোথা থেকে?” কমল মুখ নত করিয়া, নিরীহ ভাল মানুষের মত বলিলেন, “আজ্ঞে, খোকা ধরিয়া আনিল |” নগেন্দ্র বলিলেন, “বটে! মার পাজিকে!” এই বলিয়া খোকাকে কোলে লইয়া দণ্ডস্বরূপ তাহার মুখচুম্বন করিলেন। খোকা কৃতজ্ঞ হইয়া তাঁহার গায়ে লাল দিল, আর গোঁপ ধরিয়া টানিল।

কুন্দনন্দিনীর সঙ্গে কমলমণির ঐরূপ আলাপ হইল,-“ওলো কুঁদী–কুঁদী মুদী দুঁদী–ভাল আছিস ত কুঁদী?”

কুঁদী অবাক হইয়া রহিল। কিছুকাল ভাবিয়া চিন্তিয়া বলিল, “আছি|”

“আছি দিদি–আমায় দিদি বলবি–না বলিস ত ঘুমিয়া থাকিবি আর তোর চুলে আগুন ধরিয়ে দিব। আর নহিলে গায়ে আরসুলো ছাড়িয়া দিব |”

কুন্দ দিদি বলিতে আরম্ভ করিল। যখন কলিকাতায় কুন্দ কমলের কাছে থাকিত, তখন কমলকে কিছু বলিত না। বড় কথাও কহিত না। কিন্তু কমলের যে প্রকৃতি চিরপ্রেমময়ী, তাহাতে সে তখন হইতেই তাঁহাকে ভালবাসিতে আরম্ভ করিয়াছিল। মধ্যে কয় বৎসর অদর্শনে কতক কতক ভুলিয়া গিয়াছিল। কিন্তু এক্ষণে কমলের স্বভাবগুণে, কুন্দেরও স্বভাবগুণে, সেই ভালবাসা নূতন হইয়া বৃদ্ধি পাইতে লাগিল।

প্রণয় গাঢ় হইল। এদিকে কমলমণি স্বামীর গৃহে যাইবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন; সূর্যমুখী বলিলেন, “না ভাই! আর দু-দিন থাক! তুমি গেলে আমি আর বাঁচিব না। তোমার কাছে সকল কথা বলাও সোয়াস্তি|” কমল বলিলেন, “তোমার কাজ না করিয়া যাইব না |” সূর্যমুখী বলিলেন, “আমার কি কাজ করিবে?” কমলমণি মুখে বলিলেন, “তোমার শ্রাদ্ধ,” মনে বলিলেন, “তোমার কণ্টকোদ্ধার |”

কুন্দনন্দিনী কমলের যাওয়ার কথা শুনিয়া আপন ঘরে গিয়া লুকাইয়া কাঁদিল, কমলমণি লুকাইয়া লুকাইয়া পশ্চাৎ পশ্চাৎ গেল। কুন্দনন্দিনী বালিসে মাথা দিয়া কাঁদিতেছে, কমলমণি তাহার চুল বাঁধিতে বসিল। চুল বাঁধা কমলের একটা রোগ।

চুল বাঁধা সমাপ্ত হইলে, কুন্দের মাথা তুলিয়া, কমল তাহার মস্তক আপনার কোলে রাখিলেন। অঞ্চল দিয়া তাহার চক্ষু মুছাইয়া দিলেন। এই সব কাজ শেষ করিয়া, শেষে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কুঁদি, কাঁদিতেছিলি কেন?”

কুন্দ বলিল, “তুমি যাবে কেন?”

কমলমণি একটু হাসিলেন। কিন্তু ফোঁটা দুই চক্ষের জল সে হাসি মানিল না–না বলিয়া কহিয়া তাহারা কমলমণির গণ্ড বহিয়া হাসির উপর আসিয়া পড়িল। রৌদ্রের উপর বৃষ্টি হইল।

কমলমণি বলিলেন, “তাতে কাঁদিস কেন?”

কু। তুমিই আমায় ভালবাস।

ক। কেন–আর কেহ কি ভালবাসে না?

কুন্দ চুপ করিয়া রহিল।