বিষবৃক্ষ
ক। কে ভালবাসে না? গিন্নী ভালবাসে না–না? আমায় লুকুস নে।
কুন্দ নীরব।
ক। দাদাবাবু ভালবাসে না?
কুন্দ নীরব।
কমল বলিলেন, “যদি আমি তোমায় ভালবাসি–আর তুমি আমায় ভালবাস, তবে কেন আমার সঙ্গে চল না?”
কুন্দ তথাপি কিছু বলিল না। কমল বলিলেন, “যাবে?” কুন্দ ঘাড় নাড়িল। “যাব না |”
কমলের প্রফুল্ল মুখ গম্ভীর হইল।
তখন কমলমণি সস্নেহে কুন্দনন্দিনীর মস্তক বক্ষে তুলিয়া লইয়া ধারণ করিলেন, এবং সস্নেহে তাহার গণ্ডদেশ গ্রহণ করিয়া কহিলেন, “কুন্দ, সত্য বলিবি?”
কুন্দ বলিল, “কি?”
কমল বলিলেন, “যা জিজ্ঞাসা করিব? আমি তোর দিদি–আমার কাছে লুকুস নে–আমি কাহারও কাছে বলিব না |” কমল মনে মনে রাখিলেন, “যদি বলি ত রাজমন্ত্রী শ্রীশ বাবুকে। আর খোকার কাণে কাণে |”
কুন্দ বলিল, “কি বল?”
ক। তুই দাদাবাবুকে বড় ভালবাসিস।-না?”
কুন্দ উত্তর দিল না। কমলমনির হৃদয়মধ্যে মুখ লুকাইয়া কাঁদিতে লাগিল।
কমল বলিলেন, “বুঝিছি–মরিয়াছ। মর তাতে ক্ষতি নাই–কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অনেকে মরে যে?”
কুন্দনন্দিনী মস্তক উত্তোলন করিয়া কমলের মুখপ্রতি স্থিরদৃষ্টি করিয়া রহিল। কমলমণি প্রশ্ন বুঝিলেন। বলিলেন, “পোড়ারমুখি চোখের মাথা খেয়েছ? দেখিতে পাও না যে __” মুখের কথা মুখে কথা রহিল–তখন ঘুরিয়া কুন্দের উন্নত মস্তক আবার কমলমণির বক্ষের উপর পড়িল। কুন্দনন্দিনীর অশ্রুজলে কমলমণির হৃদয় প্লাবিত হইল। কুন্দনন্দিনী অনেকক্ষণ নীরবে কাঁদিল–বালিকার ন্যায় বিবশা হইয়া কাঁদিল। সে কাঁদিল, আবার পরের চক্ষের জলে তাহার চুল ভিজিয়া গেল।
ভালবাসা কাহাকে বলে, সোণার কমল তাহা জানিত। অন্ত:করণের অন্ত:করণ মধ্যে কুন্দনন্দিনীর দু:খে দু:খী, সুখে সুখী হইল। কুন্দনন্দিনীর চক্ষু মুছাইয়া কহিল, “কুন্দ!”
কুন্দ আবার মাথা তুলিয়া চাহিল।
ক। আমার সঙ্গে চল।
কুন্দের চক্ষে আবার জল পড়িতে লাগিল। কমল বলিল, “নহিলে নয়।-সোণার সংসার ছারখার গেল |”
কুন্দ কাঁদিতে লাগিল। কমল বলিলেন, “যাবি? মনে করিয়া দেখ?__”
কুন্দ অনেকক্ষণ পরে চক্ষু মুছিয়া উঠিয়া বসিয়া বলিল, “যাব |”
অনেকক্ষণ পরে কেন? তাহা কমল বুঝিল। বুঝিল যে, কুন্দনন্দিনী পরের মঙ্গলমন্দিরে আপনার প্রাণের প্রাণ বলি দিল। নগেন্দ্রের মঙ্গলার্থ, সূর্যমুখীর মঙ্গলার্থ, নগেন্দ্রকে ভুলিতে স্বীকৃত হইল। সেই জন্য অনেকক্ষণ লাগিল। আপনার মঙ্গল? কমল বুঝিয়াছিলেন যে, কুন্দনন্দিনী আপনার মঙ্গল বুঝিতে পারে না।