বিষবৃক্ষ
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : মহাসমর
কমলমণির আসন টলিল। আর তিনি থাকিতে পারিলেন না। কমলমণি রমণীরত্ন। অমনি স্বামীর কাছে গেলেন।
শ্রীশচন্দ্র অন্ত:পুরে বসিয়া, আপিসের আয়ব্যয়ের হিসাব কিতাব দেখিতেছিলেন। তাঁহার পাশে, বিছানায় বসিয়া, এক বৎসরের পুত্র সতীশচন্দ্র ইংরেজী সংবাদপত্রখানি অধিকার করিয়াছিলেন। সতীশচন্দ্র সংবাদপত্রখানি প্রথমে ভোজনের চেষ্টা দেখিয়াছিল, কিন্তু তাহাতে কৃতকার্য হইতে না পারিয়া এক্ষণে পাতিয়া বসিয়াছিল।
কমলমণি স্বামীর নিকটে গিয়া গললগ্নীকৃতবাসা হইয়া, ভূমিষ্ঠা হইয়া প্রণাম করিলেন। এবং করজোড় করিয়া কহিলেন, “সেলাম পৌঁছে মহারাজ!”
(ইতিপূর্বেই বাড়ীতে গোবিন্দ অধিকারীর যাত্রা হইয়া গিয়াছিল।)
শ্রীশচন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, “আবার শশা চুরি নাকি?”
ক। শশা কাঁকুড় নয়। এবার বড় ভারি জিনিস চুরি গিয়াছে।
শ্রী। কোথায় কি চুরি হলো?
ক। গোবিন্দপুরে চুরি হয়েছে। দাদাবাবুর একটি সোণার কৌটায় এক কড়া কাণা কড়ি ছিল, তাই কে নিয়া গিয়াছে।
শ্রীশ বুঝিতে না পারিয়া বলিলেন, “তোমার দাদাবাবুর সোণার কৌটা ত সূর্যমুখী –কাণা কড়িটি কি?”
ক। সূর্যমুখীর বুদ্ধিখানি।
শ্রীশচন্দ্র বলিলেন, “তাই লোকে বলে যে, যে খেলে, সে কাণা কড়িতে খেলে। সূর্যমুখী ঐ কাণা কড়িতেই তোমার ভাইকে কিনে রেখেছে–আর তোমার এতটা বুদ্ধি থাকিতেও ভাই___” কমলমণি শ্রীশচন্দ্রের মুখ টিপিয়া ধরিলেন। ছাড়িয়া দিলে শ্রীশ বলিলেন, “তা কাণা কড়িটি চুরি করলে কে?”
ক। তা ত জানি না–কিন্তু তার পত্র পড়িয়া বুঝিলাম যে, সে কাণা কড়িটি খোওয়া গিয়াছে–নহিলে মাগী এমন পত্র লিখিবে কেন?
শ্রী। পত্রখানি দেখিতে পাই?
কমলমণি শ্রীশচন্দ্রের হাতে সূর্যমুখীর পত্র দিয়া কহিলেন, “এই পড়। সূর্যমুখী তোমাকে এ সকল কথা বলিতে মানা করিয়াছে–কিন্তু যতক্ষণ তোমাকে সব না বলিতেছি, ততক্ষণ আমার প্রাণ খাবি খেতেছে। তোমাকে পত্র না পড়াইলে আহার নিদ্রা হইবে না–ঘুরণী রোগই বা উপস্থিত হয়।”
শ্রীশচন্দ্র পত্র হস্তে লইয়া চিন্তা করিয়া বলিলেন, “যখন তোমাকে নিষেধ করিয়াছে, তখন আমি এ পত্র দেখিব না। কথাটা কি, তা শুনিতেও চাহিব না। এখন কি করিতে হইবে কি, তাই বল |”
ক। করতে হবে এই–সূর্যমুখীর বুদ্ধিটুকু গিয়াছে, তার একটু বুদ্ধি চাই। বুদ্ধি দেয় এমন লোক আর কে আছে–বুদ্ধি যা কিছু আছে, তা সতীশ বাবুর। তাই সতীশ বাবুকে একবার গোবিন্দপুর যেতে তার মামী লিখে পাঠিয়েছে।
সতীশ বাবু ততক্ষণ একটা ফুলদানি ফুলসমেত উল্টাইয়া ফেলিয়াছিলেন, এবং তৎপরে দোয়াতের উপর নজর করিতেছিলেন। দেখিয়া শ্রীশচন্দ্র কহিলেন, “উপযুক্ত বুদ্ধিদাতা বটে। তা যাহা হোক, এতক্ষণে বুঝিলাম–ভাজের বাড়ী মশায়ের নিমন্ত্রণ। সতীশকে যেতে হলেই সুতরাং কমলমণিও যাবে। তা সূর্যমুখীর কাণা কড়িটি না হারালে আর এমন কথা লিখবে কেন?”