আনন্দমঠ
ভ। তুমি আবার বিবাহ করিতে পার, তোমার পুনর্জন্ম হইয়াছে।
ক। আমার কন্যা আনিয়া দাও।
ভ। দিব, তুমি আবার বিবাহ করিতে পার।
ক। তোমার সঙ্গে নাকি?
ভ। যদি তাই হয়?
ক। সন্তানধর্ম কোথায় থাকিবে?
ভ। অতল জলে।
ক। পরকাল?
ভ। অতল জলে?
ক। এই মহাব্রত? এই ভবানন্দ নাম?
ভ। অতল জলে।
ক। কিসের জন্য এ সব অতল জলে ডুবাইবে?
ভ। তোমার জন্য। দেখ, মনুষ্য হউন, ঋষি হউন, সিদ্ধ হউন, দেবতা হউন, চিত্ত অবশ ; সন্তানধর্ম আমার প্রাণ, কিন্তু আজ প্রথম বলি, তুমিই আমার প্রাণাধিক প্রাণ। যে দিন তোমায প্রাণদান করিয়াছিলাম, সেই দিন হইতে আমি তোমার পদমূলে বিক্রীত। আমি জানিতাম না যে, সংসারে এ রূপরাশি আছে। এমন রূপরাশি আমি কখন চক্ষে দেখিব জানিলে, কখন সন্তানধর্ম গ্রহণ করিতাম না। এ ধর্ম এ আগুনে পুড়িয়া ছাই হয়। ধর্ম পুড়িয়া গিয়াছে, প্রাণ আছে। আজি চারি বৎসর প্রাণও পুড়িতেছে, আর থাকে না! দাহ! কল্যাণী দাহ! জ্বালা! কিন্তু জ্বলিবে যে ইন্ধন, তাহা আর নাই। প্রাণ যায়। চারি বৎসর সহ্য করিয়াছি, আর পারিলাম না। তুমি আমার হইবে?
ক। তোমারই মুখে শুনিয়াছি যে, সন্তানধর্মের এই এক নিয়ম যে, যে ইন্দ্রিয়পরবশ হয়, তার প্রায়শ্চিত্ত মৃত্যু। এ কথা কি সত্য?
ভ। এ কথা সত্য।
ক। তবে তোমার প্রায়শ্চিত্ত মৃত্যু?
ভ। আমার একমাত্র প্রায়শ্চিত্ত মৃত্যু।
ক। আমি তোমার মনস্কামনা সিদ্ধ করিলে, তুমি মরিবে?
ভ। নিশ্চিত মরিব।
ক। আর যদি মনস্কামনা সিদ্ধ না করি?
ভ। তথাপি মৃত্যু আমার প্রায়শ্চিত্ত; কেন না, আমার চিত্ত ইন্দ্রিয়ের বশ হইয়াছে।
ক। আমি তোমার মনস্কামনা সিদ্ধ করিব না। তুমি কবে মরিবে?
ভ। আগামী যুদ্ধে।
ক। তবে তুমি বিদায় হও। আমার কন্যা পাঠাইয়া দিবে কি?
ভবানন্দ সাশ্রুলোচনে বলিল, “দিব। আমি মরিয়া গেলে আমায় মনে রাখিবে কি?”
কল্যাণী বলিল, রাখিব। ব্রতচ্যুত অধর্মী বলিয়া মনে রাখিব |”
ভবানন্দ বিদায় হইল, কল্যাণী পুথি পড়িতে বসিল।