কপালকুণ্ডলা
লু। কুপ্রবৃত্তি নহে। অনেক দিন আগ্রায় বেড়াইলাম, কি ফললাভ হইল? সুখের তৃষ্ণা বাল্যাবধি বড়ই প্রবল ছিল। সেই তৃষ্ণার পরিতৃপ্তির জন্য বঙ্গদেশ ছাড়িয়া এ পর্যন্ত আসিলাম। এ রত্ন কিনিবার জন্য কি ধন না দিলাম? কোন্ দুষ্কর্ম না করিয়াছি? আর যে যে উদ্দেশ্যে এতদূর করিলাম, তাহার কোনটাই বা হস্তগত হয় নাই? ঐশ্বর্য্য, সম্পদ, ধন, গৌরব, প্রতিষ্ঠা সকলই ত প্রচুরপরিমাণে ভোগ করিলাম। এত করিয়াও কি হইল? আজি এইখানে বসিয়া সকল দিন মনে মনে গণিয়া বলিতে পারি যে, এক দিনের তরেও সুখী হই নাই, এক মুহূর্ত্ত জন্যও কখনও সুখভোগ করি নাই। কখন পরিতৃপ্ত হই নাই। কেবল তৃষা বাড়ে মাত্র। চেষ্টা করিলে আরও সম্পদ্, আরও ঐশ্বর্য্য লাভ করিতে পারি, কিন্তু কি জন্য? এ সকলে যদি সুখ থাকিত, তবে এত দিন এক দিনের তরেও সুখী হইতাম। এই সুখাকাঙ্ক্ষা পার্বতী নির্ঝরিণীর ন্যায়,-প্রথমে নির্মল, ক্ষীণ ধারা বিজন প্রদেশ হইতে বাহির হয়, আপন গর্ভে আপনি লুকাইয়া রহে, কেহ জানে না; আপনা আপনি কল কল করে, কেহ শুনে না। ক্রমে যত যায়, তত দেহ বাড়ে, তত পঙ্কিল হয়। শুধু তাহাই নয়; কখনও আবার বায়ু বহে, তরঙ্গ হয়, মকর কুম্ভীরাদি বাস করে। আরও শরীর বাড়ে জল আরও কর্দমময় হয়, লবণময় হয়, অগণ্য সৈকত চর–মরুভূমি নদীহৃদয়ে বিরাজ কর, বেগ মন্দীভূত হইয়া যায়, তখন সেই সকর্দম নদীশরীর অনন্ত সাগরে কোথায় লুকায়, কে বলিবে?
পে। আমি ইহার ত কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। এ সবে তোমার সুখ হয় না কেন?
লু। কেন হয় না, তা এত দিনে বুঝিয়াছি। তিন বৎসর রাজপ্রাসাদের ছায়ায় বসিয়া যে সুখ না হইয়াছে, উড়িষ্যা হইতে প্রত্যাগমনের পথে এক রাত্রে সে সুখ হইয়াছে। ইহাতেই বুঝিয়াছি।
পে। কি বুঝিয়াছ?
লু। আমি এত কাল হিন্দুদিগের দেবমূর্তি মত ছিলাম। বাহিরে সুবর্ণ রত্নাদিতে খচিত; ভিতরে পাষাণ। ইন্দ্রিয়সুখাণ্বেষণে আগুনের মধ্যে বেড়াইয়াছি, কখনও আগুন স্পর্শ করি নাই। এখন একবার দেখি, যদি পাষাণমধ্যে খুঁজিয়া একটা রক্তশিরাবিশিষ্ট অন্ত:করণ পাই।
পে। এও ত কিছু বুঝিতে পারিলাম না।
লু। আমি এই আগ্রায় কখনও কাহাকে ভালবাসিয়াছি?
পে। (চুপি চুপি) কাহাকেও না।
লু। তবে পাষাণী নই ত কি?
পে। তা এখন যদি ভালবাসিতে ইচ্ছা হয়, ভালবাস না কেন?
লু। মানস ত বটে। সেই জন্য আগ্রা ত্যাগ করিয়া যাইতেছি।
পে। তারই বা প্রয়োজন কি? আগ্রায় কি মানুষ নাই যে, চুয়াড়ের দেশে যাইবে? এখন যিনি তোমাকে ভালবাসেন, তাঁহাকেই কেন ভালবাস না? রূপে বল, ধনে বল, ঐশ্বর্য্যে বল, যাহাতে বল, দিল্লীর বাদশাহের বড় পৃথিবীতে কে আছে?
লু। আকাশে চন্দ্রসূর্য্য থাকিতে জল অধোগামী কেন?
পে। কেন?
লু। ললাটলিখন।
লুৎফ-উন্নিসা সকল কথা খুলিয়া বলিলেন না। পাষাণমধ্যে অগ্নি প্রবেশ করিয়াছিল। পাষাণ দ্রব হইতেছিল।