রাজসিংহ
চ। সে কি? বাহুতে বল থাকিলে কোন্ রাজপুত শরণাগতকে রক্ষা করে নাই? আমি তাই ভাবিতেছিলাম নির্ম।ল ! আমি এ বিপদে সেই সংগ্রাম, প্রতাপের বংশতিলকেরাই শরণ লইব–তিনি কি আমায় রক্ষা করিবেন না?
বলিতে বলিতে চঞ্চলদেবী ঢাকা ছবিখানি উল্টাইলেন–নির্মণল দেখিল, সে রাজসিংহের মূর্তিব। চিত্র দেখিয়া রাজকুমারী বলিতে লাগিলেন, “দেখ সখি, এ রাজকান্তি দেখিয়া তোমার কি বিশ্বাস হয় না যে, ইনি অগতির গতি, অনাথার রক্ষক? আমি যদি ইহার শরণ লই, ইনি কি রক্ষা করিবেন না?”
নির্মিলকুমারী অতি স্থিরবুদ্ধিশালিনী–চঞ্চলের সহোদরাধিকা। নির্মকল অনেক ভাবিল। শেষে চঞ্চলের প্রতি স্থিরদৃষ্টি করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “রাজকুমারি! যে বীর তোমাকে এ বিপদ্ হইতে রক্ষা করিবে, তাহাকে তুমি কি দিবে?”
রাজকুমারী বুঝিলেন। কাতর অথচ অধিকম্পিত কণ্ঠে বলিলেন, “কি দিব সখি! আমার কি আর দিবার আছে? আমি যে অবলা!”
নি । তোমার তুমিই আছ।
চঞ্চল অপ্রতিভ হইয়া বলিল, “দূর হ!”
নির্ম ল । তা রাজার ঘরে এমন হইয়া থাকে। তুমি যদি রুক্মিণী হইতে পার, যদুপতি আসিয়া অবশ্য উদ্ধার করিতে পারেন।
চঞ্চলকুমারী মুখাবনত করিল। যেমন সূর্যোাদয়কালে মেঘমালার উপর আলোর তরঙ্গের পর উজ্জ্বলতর তরঙ্গ আসিয়া পলকে পলকে নূতন সৌন্দর্যম উন্মেষিত করে, চঞ্চলকুমারীর মুখে তেমনই পলকে পলকে সুখের, লজ্জার, সৌন্দর্যেমর নবনবোন্মেষ হইতে লাগিল। বলিল, “তাঁহাকে পাইব, আমি কি এমন ভাগ্য করিয়াছি? আমি বিকাইতে চাহিলে তিনি কি কিনিবেন?”
নি। সে কথার বিচারক তিনি–আমরা নই। রাজসিংহের বাহুতে শুনিয়াছি, বল আছে; তাঁর কাছে কি দূত পাঠান যায় না? গোপনে–কেহ না জানিতে পারে, এরূপ দূত কি তাঁহার কাছে যায় না?
চঞ্চল ভাবিল। বলিল, “তুমি আমার গুরুদেবকে ডাকিতে পাঠাও। আমায় আর কে তেমন ভালবাসে? কিন্তু তাঁহাকে সকল কথা বুঝাইয়া বলিয়া আমার কাছে আনিও। সকল কথা বলিতে আমার লজ্জা করিবে |”
এমন সময়ে সখীজন সংবাদ লইয়া আসিল যে, একজন মতিওয়ালী মতি বেচিতে আসিয়াছে। রাজকুমারী বলিলেন, “এখন আমার মতি কিনিবার সময় নহে। ফিরাইয়া দাও |” পুরবাসিনী বলিল, “আমরা ফিরাইবার চেষ্টা করিয়াছিলাম, কিন্তু সে কিছুতেই ফিরিল না। বোধ হইল যেন, তার কি বিশেষ দরকার আছে ?” তখন অগত্যা চঞ্চলকুমারী তাহাকে ডাকিলেন।
মতিওয়ালী আসিয়া কতকগুলি ঝুটা মতি দেখাইল। রাজকুমারী বিরক্তি হইয়া বলিলেন, “এই ঝুটা মতি দেখাইবার জন্য তুমি এত জিদ করিতেছিলে?”
মতিওয়ালী বলিল, “না। আমার আরও দেখাইবার জিনিস আছে। কিন্তু তাহা আপনি একটু পুষিদা না হইলে দেখাইতে পারি না |”
চঞ্চলকুমারী বলিল, “আমি একা তোমার সঙ্গে কথা কহিতে পারিব না; কিন্তু একজন সখী থাকিবে। নির্মলল থাক, আর সকলে বাহিরে যাও |”
তখন আর সকলে বাহিরে গেল। দেবী–সে মতিওয়ালী দেবী ভিন্ন আর কেহ নয়–যোধপুরী বেগমের পাঞ্জা দেখাইল। দেখিয়া, পড়িয়া চঞ্চলকুমারী জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ পাঞ্জা তুমি কোথায় পাইলে?”