রাজসিংহ
দ্বিতীয় খণ্ড
নন্দনে নরক
প্রথম পরিচ্ছেদ : অদৃষ্টগণনা
প্রথম পরিচ্ছেদ : অদৃষ্টগণনা
জ্যোৎস্নালোকে, শ্বেতসৈকত-পুলিন-মধ্যবাহিনী নীলসলিলা যমুনার উপকূলে নগরীগণপ্রধানা মহানগরী দিল্লী, প্রদীপ্ত মণিখণ্ডবৎ জ্বলিতেছে–সহস্র সহস্র মর্মরাদিপ্রস্তরনির্মিত মিনার গম্বুজ বুরুজ ঊর্ধ্বে উত্থিত হইয়া চন্দ্রালোকের রশ্মিরাশি প্রতিফলিত করিতেছে। অতিদূরে কুতবমিনারের বৃহচ্চূড়া, ধূমময় উচ্চস্তম্ভবৎ দেখা যাইতেছিল, নিকটে জুম্মা মসজিদের চারি মিনার নীলকাশ ভেদ করিয়া চন্দ্রলোকে উঠিয়াছে । রাজপথে রাজপথে পন্যবীথিকা ; বিপণিতে শত শত দীপমালা, পুষ্পবিক্রেতার পুষ্পরাশির গন্ধ, নাগরিকজনপরিহিত পুষ্পরাজির গন্ধ, আতর-গোলাবের সুগন্ধ, গৃহে গৃহে সঙ্গীতধ্বনি, বহুজাতীয় বাদ্যের নিক্কণ, নাগরীগণের কখন উচ্চ, কখন মধুর হাসি, অলঙ্কার শিঞ্জিত,-এই সমস্ত একত্রিত হইয়া, নরকে নন্দনকাননের ছায়ার ন্যায় অদ্ভুত প্রকার মোহ জন্মাইতেছে। ফুলের ছড়াছড়ি, আতর-গোলাবের ছড়াছড়ি,-নর্তকীর নূপুরনিক্কণ, গায়িকার কণ্ঠে সপ্তসুরের আরোহণ অবরোহণ, বাদ্যের ঘটা, কমনীয়কামিনীকরতলকলিত তালের চট-চটা; মদ্যের প্রবাহ, বিলোল কটাক্ষবহ্নি প্রবাহ; খিচুড়ি পোলাওয়ের রাশি রাশি; বিকট, কপট, মধুর, চতুর, চতুর্বিধ হাসি; পথে পথে অশ্বের পদধ্বনি, দোলার বাহকের বীভৎস ধ্বনি, হস্তীর গালঘণ্টার ধ্বনি, এক্কার ঝনঝনি–শকটের ঘ্যানঘ্যানানি।
নগরের মধ্যে বড় গুলজার চাঁদনী চৌক। সেখানে রাজপুত বা তুর্কী অশ্বারূঢ় হইয়া স্থানে স্থানে পাহারা দিতেছে। জগতে যাহা কিছু মূল্যবান্, তাহা দোকান সকলে থরে থরে সাজান আছে। কোথাও নর্তকী রাস্তায় লোক জমাইয়া, সারঙ্গের সুরে নাচিতেছে, গায়িতেছে ; কোথাও বাজিকর বাজি করিতেছে, প্রত্যেকের নিকট শত শত দর্শক ঘেরিয়া দাঁড়াইয়া দর্শন করিতেছে। সকলের অপেক্ষা জনতা “জ্যোতিষী” দিগের কাছে। মোগল বাদশাহদিগের সময়ে জ্যোতির্বিদগণের যেরূপ আদর ছিল, এমন বোধ হয়, আর কখনও হয় নাই। হিন্দু মুসলমানে তাঁহাদের তুল্য আদর করিতেন। মোগল বাদশাহেরা জ্যোতিষ শাস্ত্রের অতিশয় বশীভূত ছিলেন; তাঁহাদিগের গণনা না জানিয়া অনেক সময়ে অতি গুরুতর কার্যে প্রবৃত্ত হইতেন না। যে সকল ঘটনা এই গ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে, তাহার কিছু পরে ঔরঙ্গজেবের কনিষ্ঠ পুত্র আকব্বর রাজবিদ্রোহী হইয়াছিলেন। পঞ্চাশ হাজার রাজপুত সেনা তাঁহার সহায় ছিল; ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে অল্প সেনাই ছিল, কিন্তু জ্যোতির্বিদের গণনার উপর নির্ভর করিয়া আকব্বর সৈন্যযাত্রায় বিলম্ব করিলেন, ইতিমধ্যে ঔরঙ্গজেব কৌশল করিয়া তাঁহার চেষ্টা নিষ্ফল করিলেন।
দিল্লীর চাঁদনী-চৌকে, জ্যোতিষিগণ রাজপথে আসন পাতিয়া, পুথি পাঁজি লইয়া, মাথায় উষ্ণীষ বাঁধিয়া বসিয়া আছেন–শত শত স্ত্রীপুরুষ, আপন আপন অদৃষ্ট গণাইবার জন্য তাঁহাদের কাছে গিয়া বসিয়া আছে; পরদানশীন বিবিরাও মুড়িসুড়ি দিয়া যাইতে সঙ্কোচ করেন নাই। একজন জ্যোতিষীর আসনের চারি পাশে বড় জনতা। তাহার বাহিরে একজন অবগুণ্ঠনবতী যুবতী ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। জ্যোতিষীর কাছে যাইবার ইচ্ছা, কিন্তু সাহস করিয়া জনতা ঠেলিয়া প্রবেশ করিতে পারিতেছে না–ইতস্তত: দেখিতেছে। এমন সময়ে সেই স্থান দিয়া, একজন অশ্বারোহী পুরুষ যাইতেছিল।
অশ্বারোহী যুবা পুরুষ। দেখিয়া আহেলে-বিলায়ত মোগল বলিয়া বোধ হয়। তিনি অত্যন্ত সুশ্রী, মোগলের ভিতরও এরূপ সুশ্রী পুরুষ দুর্লভ। তাঁহার বেশভূষার অতিশয় পারিপাট্য। দেখিয়া একজন বিশেষ সম্ভ্রান্ত লোক বলিয়া বোধ হয়। অশ্বও সম্ভ্রান্তবংশীয়।