রাজসিংহ
তৃতীয় খণ্ড
বিবাহে বিকল্প
প্রথম পরিচ্ছেদ : বক ও হংসীর কথা
প্রথম পরিচ্ছেদ : বক ও হংসীর কথা
নির্মল ধীরে ধীরে রাজকুমারীর কাছে গিয়া বসিলেন। দেখিলেন, রাজকুমারী একা বসিয়া কাঁদিতেছেন। সে দিন যে চিত্রগুলি ক্রীত হইয়াছিল, তাহার একখানি রাজকুমারীর হাতে দেখিলেন। নির্মেল কে দেখিয়া চঞ্চল চিত্রখানি উল্টাইয়া রাখিলেন–কাহার চিত্র, নির্ময়লের তাহা বুঝিতে বাকি রহিল না। নির্ম্ল কাছে গিয়া বসিয়া বলিল, “এখন উপায়?”
চ। উপায় যাই হউক–আমি মোগলের দাসী কখনই হইব না।
নি । তোমার অমত, তা ত জানি, কিন্তু আলম্গী র বাদশাহের হুকুম, রাজার কি সাধ্য যে, অন্যথা করেন? উপায় নাই, সখি!–সুতরাং তোমাকে ইহা অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে। আর স্বীকার করা ত সৌভাগ্যের বিষয়। যোধপুর বল, অম্বর বল; রাজা, বাদশাহ, ওমরাহ, নবাব, সুবা যাহা বল, পৃথিবীতে এত বড় লোক কে আছে যে, তাহার কন্যা দিল্লীর তক্তে বসিতে বাসনা করে না? পৃথিবীশ্বরী হইতে তোমার এত অসাধ কেন?
চঞ্চল রাগ করিয়া বলিল, “তুই এখান হইতে উঠিয়া যা |”
নির্ম ল দেখিল, ও পথে কিছু হইবে না। তবে আর কোন পথে রাজকুমারীর কিছু উপকার যদি করিতে পারে, তাহার সন্ধান করিতে লাগিল। বলিল, “আমি যেন উঠিয়া গেলাম–কিন্তু যাঁহার দ্বারা প্রতিপালিত হইতেছি, আমাকে তাঁহার হিত খুঁজিতে হয়। তুমি যদি দিল্লী না যাও, তবে তোমার বাপের দশা কি হইবে, তাহা কি একবার ভাবিয়াছ?”
চঞ্চল। ভাবিয়াছি। আমি যদি না যাই, তবে আমার পিতার কাঁধে মাথা থাকিবে না– রূপনগরের গড়ের একখানি পাতর থাকিবে না, তা ভাবিয়াছি–আমি পিতৃহত্যা করিব না। বাদশাহের ফৌজ আসিলেই আমি তাহাদিগের সঙ্গে দিল্লী যাত্রা করিব। ইহা স্থির করিয়াছি।
নির্মমল প্রসন্ন হইল। বলিল, “আমিও সেই পরামর্শই দিতেছিলাম |”
রাজকুমারী ভ্রূভঙ্গী করিলেন–বলিলেন, “তুই কি মনে করেছিস যে, আমি দিল্লীতে গিয়া মুসলমান বানরের শয্যায় শয়ন করিব? হংসী কি বকের সেবা করে?”
নির্মাল কিছুই বুঝিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তবে কি করিবে?”
চঞ্চলকুমারী হস্তের একটি অঙ্গুরীয় নির্ম লকে দেখাইল; বলিল, “দিল্লীর পথে বিষ খাইব |” নির্ম ল জানিত, ঐ অঙ্গুরীয়তে বিষ আছে।
নির্মাল বলিল, “আর কি কোন উপায় নাই?”
চঞ্চল বলিল, “আর উপায় কি সখি? কে এমন বীর পৃথিবীতে আছে যে, আমায় উদ্ধার করিয়া দিল্লীশ্বরের সহিত শত্রুতা করিবে? রাজপুতানার কুলাঙ্গার সকলই মোগলের দাস–আর কি সংগ্রাম আছে, না প্রতাপ আছে?”
নি। কি বল রাজকুমারি! সংগ্রাম, কি প্রতাপ যদি থাকিত, তবে তাহারাই বা তোমার জন্য সর্বমস্ব পণ করিয়া দিল্লীর বাদশাহের সঙ্গে বিবাদ করিবে কেন? পরের জন্য কেহ সহজে সর্ব স্ব পণ করে না। প্রতাপ নাই, সংগ্রাম নাই, রাজসিংহ আছে–কিন্তু তোমার জন্য রাজসিংহ সর্ব স্ব পণ করিবে কেন? বিশেষ তুমি মাড়বারের ঘরাণা।