রাজসিংহ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : জেব উন্নিসা
দরিয়ার সংবাদ-বিক্রয়ের কি হইল? সংবাদ-বিক্রয় আবার কি? কাহাকেই বা বিক্রয় করিবে? সে কথাটা বুঝাইবার জন্য, মোগলসম্রাটের অবরোধের কিছু পরিচয় দিতে হইবে।
ভারতবর্ষীয় মহিলারা রাজ্যশাসনে সুদক্ষ বলিয়া বিখ্যাত। পশ্চিমে, কদাচিৎ একটা জেনোবিয়া, ইসাবেলা, এলিজাবেথ বা ক্যাথারাইন পাওয়া যায়। কিন্তু ভারতবর্ষের অনেক রাজকুলজারাই রাজ্যশাসনে সুদক্ষ। মোগলসম্রাটদিগের কন্যাগণ এ বিষয়ে বড় বিখ্যাত। কিন্তু যে পরিমাণে তাহারা রাজনীতিবিশারদ, সেই পরিমাণে তাহারা ইন্দ্রিয়পরবশ ও ভোগবিলাসপরায়ণ ছিল। ঔরঙ্গজেবের দুই ভগিনী, জাঁহানারা ও রৌশন্বারা। জাঁহানারা শাহজাঁহার বাদশাহীর প্রধান সহায়। শাহাজাঁহা তাঁহার পরামর্শ ব্যতীত কোন রাজকার্য করিতেন না; তাঁহার পরামর্শের অনুবর্তী হইয়া কার্যে সফল ও যশস্বী হইতেন। তিনি পিতার বিশেষ হিতৈষিণী ছিলেন। কিন্তু তিনি যে পরিমাণে এ সকল গুণবিশিষ্টা ছিলেন, ততোধিক পরিমাণে ইন্দ্রিয়পরায়ণা ছিলেন। ইন্দ্রিয়পরিতৃপ্তির জন্য অসংখ্য লোক তাঁহার অনুগৃহীত পাত্র ছিল। সেই সকল লোকের মধ্যে ইউরোপীয় পর্য্যটকেরা এমন ব্যক্তির নাম করেন যে, তাহা লিখিয়া লেখনী কলুষিত করিতে পারিলাম না।
রৌশন্বারা পিতৃদ্বেষিণী, ঔরঙ্গজেবের পক্ষপাতিনী ছিলেন। তিনিও জাঁহানারার মত রাজনীতিবিশারদ এবং সুদক্ষ ছিলেন, এবং ইন্দ্রিয় সম্বন্ধে জাঁহানারার ন্যায় বিচারশূন্য, বাধাশূন্য, এবং তৃপ্তিশূন্য ছিলেন। যখন পিতাকে পদচ্যুত ও অবরুদ্ধ করিয়া, তাঁহার রাজ্য অপহরণে ঔরঙ্গজেব প্রবৃত্ত, তখন রৌশন্বারা তাঁহার প্রধান সহায়। ঔরঙ্গজেবও রৌশ্বারার বড় বাধ্য ছিলেন। ঔরঙ্গজেবের বাদশাহীতে রৌশন্বারা দ্বিতীয় বাদশাহ ছিলেন।
কিন্তু রৌশন্বারার দুরদৃষ্টক্রমে তাঁহার একজন মহাশক্তিশালিনী প্রতিদ্বন্দ্বিনী তাঁহার বিরুদ্ধে মাথা তুলিল। ঔরঙ্গজেবের তিন কন্যা। কনিষ্ঠা দুইটির সঙ্গে বন্দী ভ্রাতুষ্পুত্রদ্বয়ের তিনি বিবাহ দিলেন। জ্যেষ্ঠা জেব-উন্নিসা বিবাহ করিলেন না।1 পাদ্রি কত্রু বলেন, ইঁহার নাম ফখর-উন্নিসা। পিতৃস্বসাদিগের ন্যায় বসন্তের ভ্রমরের মত পুষ্পে পুষ্পে মধুপান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন।
পিসী ভাইঝি উভয়ে অনেক স্থলেই, মদন-মন্দিরে প্রতিযোগিনী হইয়া দাঁড়াইতেন। সুতরাং ভাইঝি পিসীকে বিনষ্ট করিবার সঙ্কল্প করিলেন। পিসীর মহিমা তিনি পিতৃসমীপে বিবৃত করিতে লাগিলেন। ফল এই দাঁড়াইল যে, রৌশন্বারা পৃথিবী হইতে অদৃশ্যা হইলেন, জেব-উন্নিসা তাঁহার পদমর্যাদা ও তাঁহার পদানতগণকে পাইলেন।
পদমর্যাদার কথা বলিলাম, তাহার একটু তাৎপর্য আছে। বাদশাহের অন্ত:পুরে খোজা ভিন্ন কোন পুরুষ প্রবেশ করিত না, অন্তত: করিবার নিয়ম ছিল না। অন্ত:পুরে পাহারার কাজের জন্য একটা স্ত্রীসেনা নিযুক্ত ছিল। যেমন হিন্দুরাজগণ যবনীগণকে প্রতিহারে নিযুক্ত করিতেন, মোগল বাদশাহেরাও তাই করিতেন। তাতারজাতীয়া সুন্দরীগণ মোগলসম্রাটের অবরোধে প্রহরিণী ছিলেন। এই স্ত্রীসৈন্যের একজন নায়িকা ছিলেন; তিনি সেনাপতির স্থানীয়া। তাঁহার পদ উচ্চপদ বলিয়া গণ্য, এবং বেতন ও সম্মান তদনুযায়ী। এই পদে রৌশন্বারা নিযুক্ত ছিলেন। তিনি সহসা অপার্থিব অন্ধকারে অন্তর্হিত হইলে জেব-উন্নিসা তাঁহার পদে নিযুক্ত হইয়াছিলেন। যিনি এই পদে নিযুক্ত হইতেন, তিনি রাজান্ত:পুরের সর্ববিষয়ের কর্ত্রী হইতেন। সুতরাং জেব-উন্নিসা রঙমহালের সর্বকর্ত্রী ছিলেন। বাদশাহের অন্ত:পুরকে রঙমহাল বা মহাল বলিত। সকলেই তাঁহার অধীন; প্রতিহারিগণ, খোজারা, বাঁদীরা, দৌবারিকগণ, বাহকগণ, পাচকগণ, সকলেই তাঁহার অধীন। অতএব তিনি যাহাকে ইচ্ছা, তাহাকে মহাল মধ্যে আসিতে দিতে পারিতেন।
1-মুসলমান ইতিহাসে ইনি জেব-উন্নিসা নামে পরিচিতা।