রাজসিংহ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ : ঐশ্বর্য-নরক
দিল্লী মহানগরীর সারভূত দিল্লীর দুর্গ; দুর্গের সারভূত রাজপ্রাসাদমালা। এই রাজপ্রাসাদমালার ভিতর, অল্প ভূমিমধ্যে যত ধনরাশি, রত্নরাশি, রূপরাশি, এবং পাপরাশি ছিল, সমস্ত ভারতবর্ষে তাহা ছিল না। রাজপ্রাসাদমালার সারভূত অন্ত:পুর বা রঙমশহাল। ইহা কুবের ও কন্দর্পের রাজ্য,-চন্দ্র সূর্যা তথায় প্রবেশ করে না; যম গোপনে ভিন্ন তথায় যান না; বায়ুরও গতিরোধ। তথায় গৃহসকল বিচিত্র; গৃহসজ্জা বিচিত্র; অন্ত:পুরবাসিনী সকল বিচিত্র। এমন রত্নখচিত, ধবলপ্রস্তর-নির্মিজত কক্ষরাজি কোথাও নাই; এমন নন্দনকানননিন্দিনী উদ্যানমালা আর কোথাও নাই–এমন উর্ব্বশী-মেনকা-রম্ভার গর্বষখর্বইকারিনী সুন্দরীর সারি আর কোথাও নাই, এত ভোগবিলাস জগতে আর কোথাও নাই। এত মহাপাপ আর কোথাও নাই।
ইহার মধ্যে জেব-উন্নিসার বিলাসগৃহ আমাদের উদ্দেশ্য।
অতি মনোহর বিলাসগৃহ। শ্বেতকৃষ্ণ প্রস্তরের হর্ম তল। শ্বেতমর্মনরনির্মি ত কক্ষপ্রাচীর; পাথরে রত্নের লতা, রত্নের পাতা, রত্নের ফুল, রত্নের ফল, রত্নের পাখী, রত্নের ভ্রমর। কিয়দ্দূর ঊর্ধ্ধেত সর্ব ত্র দর্পণমণ্ডিত। তাহার ধারে ধারে সোণার কামদার বীট। ঊর্ধল রূপার তারের চন্দ্রাতপ, তাহাতে মতির ছোট ঝালর; এবং সদ্যোনিচিত পুষ্পরাশির বড় ঝালর। হর্ম্যাতলে নববর্ষাসমাগোদ্গত কোমল তৃণরাজি অপেক্ষাও সুকোমল গালিচা পাতা; তাহার উপর গজনদন্তনির্মি্ত রত্নালঙ্কৃত পালঙ্ক। তাহার উপর জরির কামদার বিছানায় জরির কামদার মখমলের বালিশ। শয্যার উপর বিবিধ পাত্রে রাশি রাশি সুগন্ধি পুষ্প, পাত্রে পাত্রে আতর-গোলাপ; সুগন্ধি, যত্ন-প্রস্তুত তাম্বূলের রাশি। আর পৃথক সুবর্ণপাত্রে সুপেয় মদ্য। সকলের মধ্যে, পুষ্পরাশিকে, রত্নরাশিকে ম্লান করিয়া, প্রৌঢ়া সুন্দরী জেব-উন্নিসা, পানপাত্র হস্তে, বাতায়নপথে, নিশীথ-নক্ষত্রশোভা নিরীক্ষণ করিতে করিতে, মৃদু পবনে পুষ্পমণ্ডিত মস্তক শীতল করিতেছিলেন, এমন সময়ে মবারক খাঁ তথায় উপস্থিত।
মবারক জেব-উন্নিসার নিকট গিয়া বসিলেন এবং তাম্বূলাদি প্রসাদ প্রাপ্ত হইয়া চরিতার্থ হইলেন।
জেব-উন্নিসা বলিল, “না খুঁজিতে যে আসে, সেই ভালবাসে |”
মবারক বলিল, “না ডাকিতে আসিয়াছি, বেয়াদবি হইয়াছে। কিন্তু ভিক্ষুক , না ডাকিতেই আসিয়া থাকে |”
জে। তোমার কি ভিক্ষা প্রাণাধিক!
ম। ভিক্ষা এই যে, যেন মোল্লার হুকুমে ঐ শব্দে আমার অধিকার হয়।
জেব-উন্নিসা হাসিয়া বলিল, “ঐ সেই পুরাতন কথা! বাদশাহজাদীরা কখন বিবাহ করে?”
ম। তোমার কনিষ্ঠা ভগিনীগণ ত বিবাহ করিয়াছে।
জে। তাহারা শাহজাদা বিবাহ করিয়াছে। বাদশাহজাদীরা শাহজাদা ভিন্ন বিবাহ করে না। বাদশাহজাদী দুইশতী মনসহবদারকে কি বিবাহ করিতে পারে?
ম। তুমি মালেকে মুলুক। তুমি বাদশাহকে যাহা বলিবে, তিনি তাহাই করিবেন, ইহা সর্ব লোকে জানে।
জে। যাহা অনুচিত, তাহাতে আমি বাদশাহকে অনুরোধ করিব না।
ম। আর এই কি উচিত, শাহজাদী?
জেব। এই কি?
ম। এই মহাপাপ।
জে। কে মহাপাপ করিতেছে?
মবারক মথা হেঁট করিল। শেষ বলিল, “তুমি কি বুঝিতেছ না?”