পাঠ্যপুস্তক
তৃতীয় অধ্যায়
পত্রলিপি
পত্র লিখিতে জানা, সকলেরই পক্ষে নিতান্ত প্রয়োজনীয়। অন্য প্রকার রচনার ক্ষমতা অনেকের পক্ষে নিষ্প্রয়োজন হইতে পারে, কিন্তু পত্র লিখিবার ক্ষমতা সকলের পক্ষে প্রয়োজনীয়। এই জন্য পত্র লেখার পদ্ধতি বলিয়া দিবার জন্য একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় লিখিলাম। পত্র লেখা অতি সহজ। বাঙ্গালায় পত্র লেখার কয়েক প্রকার পাঠ প্রচলিত আছে।
পূজ্য ব্যক্তি, যাঁহাকে প্রণাম করিতে হয়, তাঁহাকে “সেবক” ও “প্রণাম” পাঠ লিখিতে হয়। যথা—
সেবক শ্রীরমানাথ দেবশর্মণঃ প্রণামাঃ শতসহস্রনিবেদনঞ্চ বিশেষং। এই “দেবশর্মণঃ” শব্দ সম্বন্ধে একটা কথা বুঝিবার আছে। ব্রাহ্মণেরা সকলেই আপন নামের পর “শর্মা” বা “দেবশর্মা” লিখিতে বা বলিতে পারেন। রমানাথ বন্দোপাধ্যায়কে যদি কেহ জিজ্ঞাসা করে, মহাশয়ের নাম কি? তিনি উত্তর করিতে পারেন, “আমার নাম শ্রীরমানাথ শর্মা” অথবা “শ্রীরমানাথ দেবশর্মা”। কিন্তু দেখিবে পত্রের পাঠে লিখিত হইল “দেবশর্মণঃ”—“দেবশর্ম্মা” নহে। ইহার কারণ এই যে, আসল শব্দটি “শর্মণ্”। প্রথমায় ইহা শর্মা হয়—“শর্মণঃ” ষষ্ঠ্যন্ত। শব্দ ষষ্ঠ্যন্ত হইলে সম্বন্ধ পদ হয়। অতএব “শর্মণঃ” কি “দেবশর্মণঃ” বলিলে “শর্মার” ও “দেবশর্মার” বুঝায়। উপরে যে পাঠ লেখা হইয়াছে, তাহার অর্থ এই যে, “আপনার সেবক শ্রীরমানাথ দেবশর্মার শতসহস্র প্রণাম ও নিবেদন।” ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য জাতীয় লেখক হইলেও লেখকের নামটি ঐরূপ ষষ্ঠ্যন্ত হইবে, যথা—
“সেবক শ্রীরমানাথ দাস ঘোষস্য প্রণামাঃ শতসহস্রনিবেদনঞ্চ বিশেষং”।
“সেবক শ্রীরামচন্দ্র সেন গুপ্তস্য প্রণামাঃ” ইত্যাদি।
“সেবক শ্রীরামনিধি দাস বসোঃ প্রণামাঃ” ইত্যাদি।
ব্রাহ্মণকন্যারা সকলেই আপনার নামের পর “দেবী” লিখিতে পারেন, শূদ্রকন্যাদিগকে “দাসী” লিখিতে হয়। “দেবী” শব্দ ষষ্ঠ্যন্ত হইলে দেব্যাঃ” হয়; “দাসী” শব্দ “দাস্যাঃ” হয়। এজন্য মোক্ষদা দেবী কি কৃষ্ণপ্রিয়া দাসী পত্র লিখিতে গেলে, পাঠ লিখিবে,—
“মোক্ষদা দেব্যাঃ প্রণামাঃ” ইত্যাদি, “কৃষ্ণপ্রিয়া দাস্যাঃ প্রণামাঃ” ইত্যাদি।
এইরূপ ষষ্ঠ্যন্ত পদ পত্রের ভিতরে লিখিত হয় বলিয়া এ দেশের লৌকিক আচারে একটা ঘোরতর ভ্রম প্রবেশ করিয়াছে। লোকের বিশ্বাস হইয়াছে যে, স্ত্রীলোকের নামই বুঝি “দেব্যাঃ” ও দাস্যাঃ”। সাধারণ লেখকেরা, কর্তৃকারকেও “দেব্যাঃ” লেখেন, কর্মকারকেও “দেব্যাঃ” লেখেন, অপাদান, সম্প্রদান, করণ, অধিকরণ, সর্বত্রই “দেব্যাঃ” ও দাস্যাঃ”। ইহা বড় ভুল। “দেব্যাঃ” অর্থ দেবীর” ; “দাস্যাঃ” অর্থ “দাসীর”। সংস্কৃত ভিন্ন বাঙ্গালা লেখায় উহা ব্যবহৃত হইতে পারে না। পত্রের পাঠ সংস্কৃত, এই জন্য সে স্থানে ইহা ব্যবহৃত হয়। সংস্কৃতেও সম্বন্ধ না বুঝাইলে ব্যবহৃত হইবে না।
সেইরূপ “দেবশর্মণঃ”। আজিও এমন অনেক মূর্খ ব্রাহ্মণকুমার আছে যে, নাম বলিতে গেলে বলে, “আমার নাম শ্রীঅমুক দেবশর্মণঃ।” ইহা ভুল। ইহার অর্থ “আমার নাম শ্রীঅমুক দেবশর্মার।” নাম বলিতে হইবে, “আমার নাম শ্রীঅমুক দেবশর্মা।”