সন্ধি। সংস্কৃতের নিয়ম, সন্ধির যোগ্য দুইটি বর্ণ একত্রে থাকিলে সকল স্থানেই সন্ধি হইবে। কিন্তু বাঙ্গালার নিয়ম তাহা নহে, বাঙ্গালার সমাস ব্যতীত সন্ধি হয় না। যে দুইটি শব্দে সমাস হয় না, সে দুইটি শব্দে সন্ধিও হইবে না।

সহজ উদাহরণ;—“সঃ অস্তি,” সংস্কৃতে, “সোহস্তি” হইবে; কিন্তু বাঙ্গালায় “তিনি আছেন” “তিন্যাছেন” হইবে না। “অঙ্গুলি” “উত্থিত” এই দুইটি শব্দ সংস্কৃতে যে অবস্থায় থাকুক না কেন, মধ্যে আর কিছু না থাকিলে, “অঙ্গুল্যুত্থিত” হইয়া যাইবে, কিন্তু বাঙ্গালায় যদি বলি, “তিনি অঙ্গুলি উত্থিত করিলেন,” সে স্থলে “তিনি অঙ্গুল্যুত্থিত করিলেন,” এরূপ কখনই লিখিতে পারিব না। কেন না এখানে সমাস নাই।

বাঙ্গালায় সন্ধির দ্বিতীয় নিয়ম এই যে, সংস্কৃতে ও অসংস্কৃতে কখন সন্ধি হইবে না। “আমার অঙ্গুলি” বলিতে হইবে, “আমারাঙ্গুলি” হয় না। সন্ধি করিতে হইলে, “মমাঙ্গুলি” বলিবে, সেও ভাল বাঙ্গালা হয় না—কেন না সমাস নাই। “মড়াহারী পক্ষী” বলা যায় না; “শবাহারী” বলিতে হইবে। “গাধাকৃত পশু” বলা যায় না ; “গর্দভাকৃত” বলিতে হইবে। সকলেই “মনান্তর” বলে, কিন্তু ইহা অশুদ্ধ। কেন না “মন” বাঙ্গালা শব্দ; সংস্কৃত মনস্, প্রথমায় মনঃ, এজন্য, “মনোদুঃখ”, “মনোরথ” শুদ্ধ।

তৃতীয় নিয়ম। যদি দুইটি শব্দ অসংস্কৃত হয়, তবে কখনই সন্ধি হইবে না। যথা, “পাকা আতা” সন্ধি হয় না।

সমাজ। সমাসেরও নিয়ম ঐরূপ ; সংস্কৃতে এবং অসংস্কৃতে সমাস হয় না। যেমন, “মহকুমাধ্যক্ষ” ; “উকীলাগ্রগণ্য” ; “মোক্তারাদি” এ সকল অশুদ্ধ। অথচ এরূপ অশুদ্ধি এখন সচরাচর দেখা যায়।

উভয় শব্দ সংস্কৃত হইলেও সমাস করা না করা লেখকের ইচ্ছাধীন। “অধরের অমৃত” বলিতে পার, অথবা “অধরামৃত” বলিতে পার। “অধরামৃত” বলিতে সমাস হইল “অধরের অমৃত” বলিলে সমাস হইল না। সন্ধি করা না করাও লেখকের ইচ্ছাধীন। কেহ লেখেন “অধরামৃত”, কেহ লেখেন “অধর অমৃত”।

বাঙ্গালায় সন্ধি সমাসের বাহুল্য ভাল নহে। সহজ রচনায় উহা যত কম হয়, তত ভাল।

প্রত্যয়। প্রত্যয় সম্বন্ধে সংস্কৃতের যে নিয়ম, বাঙ্গালা রচনায় সংস্কৃত প্রত্যয় ব্যবহারকালে সেই সকল বজায় রাখিতে হইবে। “সৌজন্যতা” “ঐক্যতা” এ সকল অশুদ্ধ। “সৌজন্য” “ঐক্য এইরূপ হইবে।

সংস্কৃত শব্দের পরে অসংস্কৃত প্রত্যয় ব্যবহার হইতে পারে না। “মূর্খামি” বলা যায় না, কেন না “মূর্খ” সংস্কৃত শব্দ, “মি” সংস্কৃত প্রত্যয় নহে ; “মূর্খতা” বলিতে হইবে। “অহম্মুখ” সংস্কৃত শব্দ ; এজন্য “আহাম্মুখি” অশুদ্ধ, “অহম্মুখতা” বলিতে হইবে।

স্ত্রীত্ব। সংস্কৃতে এই নিয়ম আছে যে, বিশেষ্য যে লিঙ্গান্ত হইবে, বিশেষণও সেই লিঙ্গান্ত হইবে। যথা, সুন্দরী বালিকা, সুন্দর বালক ; বেগবান্ নদ, বেগবতী নদী।

বাঙ্গালায় এই নিয়মের অনুবর্তী হওয়া লেখকের ইচ্ছাধীন। অনেকেই সুন্দরী বলিকা লেখেন; কিন্তু সুন্দর বালিকাও বলা যায়। বিশেষতঃ বিশেষণ বিশেষ্যের পরে থাকিলে ইহাতে কোন দোষই হয় না। যথা, “এই বালিকাটি বড় সুন্দর।” “রামের স্ত্রী বড় মুখর।” অনেক সময়ে বিশেষণ স্ত্রীলিঙ্গান্ত হইলে বড় কদর্য শুনায়। যথা, “রামের মা উত্তমা পাচিকা” এখানে “উত্তম পাচিকা” বলিতে হইবে।

বাঙ্গালা রচনায় স্ত্রীত্ব সম্বন্ধে কয়েকটি নিয়ম প্রবল ;—

১। স্ত্রীলিঙ্গান্ত বিশেষ্যের বিশেষণকে পুংলিঙ্গান্ত রাখিতে পার। যেমন সুন্দর বালিকা উর্বর ভূমি। কিন্তু পুংলিঙ্গান্ত বা ক্লীবলিঙ্গান্ত বিশেষ্যের বিশেষণকে কখন স্ত্রীলিঙ্গান্ত করিতে পার না। “পঞ্চমী দিবস” “মহতী কার্য” “সুবিস্তৃতা জনপদ” এ সকল অশুদ্ধ।