সংযোজনী
মিশ্রগণিত। মিশ্রগণিতে অজ্ঞতানিবন্ধন কত অনর্থ হইতেছে, তাহা কে গণনা করিতে পারে? আমরা উদাহরণের জন্য একটি সামান্য অনর্থের উল্লেখ করিতেছি। মানবদণ্ডের (পাল্লার দাঁড়ির) উভয় সীমা মধ্যরজ্জু হইতে সমান ব্যবধানে স্থিত না থাকিলে মানদণ্ড জলতলের সহিত সমানান্তরাল হইবে না, অর্থাৎ এক দিক অন্য দিক অপেক্ষা কিছু ঝোক্তা হইবে। এইরূপ স্থলে যে দিক উচ্চ হইয়াছে, সেই দিকে পাত্রে কিছু ভার দেওয়া অর্থাৎ পাষাণ ভাঙ্গিয়া ওজন দেওয়ার প্রথা আছে, কখন ফেরে ফেরে অর্থাৎ দুই সের দ্রব্য দিতে হইলে এক সের ঝোক্তা দিকে ওজন করিয়া আর এক সের উচ্চ দিকে ওজন করিয়া দ্রব্য দেওয়া হইয়া থাকে। কিন্তু এরূপ ফেরে ফের মাপে সর্বদাই বিক্রেতার ক্ষতি হইয়া থাকে, একথাটি মিশ্রগণিতের একটি সামান্য সত্য। মহাজনগণ যখন ঝরতি-পড়্তি শুক্তি বলিয়া মান ন্যূনতার সমাধা করিবেন, তখন বিজ্ঞান অবহেলাকে কিছু অংশ দিলে সত্যবাদীর কার্য করেন।
রেখাগণিত। লীলাবতী গ্রন্থই রেখাগণিত চর্চার প্রচুর প্রমাণ। লীলাবতী ভারতের গৌরবও বটে, ভারতের কলঙ্কও বটে। কোহিনূর হীরক মুসলমান সম্রাটগণের গৌরব চিহ্নও বটে, কলঙ্কমণিও বটে। লীলাবতী নামোল্লেখে আমাদের একটি কথা মনে পড়িয়াছে, আমরা সেইটি এই স্থানে বলিয়া পাঠককে হাসিতে বা কাঁদিতে অনুরোধ করি না। এক দিন, দীনবন্ধু বাবুর লীলাবতী নাটকের কথা হইতেছিল। বাঙ্গালি, যিনি পিরান গায়ে দেন, তিনিই সমালোচক। একজন বিজ্ঞ সমালোচক একজন আগন্তুককে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “এই খনার স্ত্রী লীলাবতী বড় (Mathematician) ছিলেন; দীনবন্ধু বাবু তাঁরি বিষয়ে নাটক লিখেছেন। এই পাঁচটা মিষ্টি কথাবার্তা আর কি?” আমরা উপস্থিত ছিলাম; হাসি কাঁদি নাই। তাহাতেই কাহাকেও হাসিতে বা কাঁদিতে বলি না। হা দীনবন্ধো! ভাস্করাচার্য! লীলাবতী! নাটক! কাব্য! সত্য! সমালোচনা! তোমাদের এই দশা হইল! কলঙ্কিনী লীলাবতী যদি না থাকিত, তাহা হইলে আমাদিগকে কখনই লজ্জাকর সমালোচন শুনিতে হইত না।
আয়ুর্বেদ, রসায়ন, উদ্ভিদ্তত্ত্ব। এগুলি মনুষ্যের কেবল শরীরধারণ পক্ষে বিশেষ প্রয়োজনীয় ও প্রাচীন ভারতে এগুলির বিশেষ সমাদর ছিল। অনুষ্ঠাতা বাবু মহেন্দ্রলাল সরকারের সাময়িক আয়ুর্বেদ পত্রে তাহার প্রচুর প্রমাণ পাওয়া যায়। অন্য প্রমাণ অনুসন্ধানের প্রয়োজন কি, এত যে অধঃপাতে গিয়াছে—ইয়ুরোপীয় অতি পারদর্শী চিকিৎসকেরা পুরাতন রোগ চিকিৎসায় বৈদ্যদিগের সমকক্ষ হইতে পারিতেছেন না। তৈল চিকিৎসা যে অতি আশ্চর্য পদ্ধতি, তাহাও স্বীকার করিতে হয়। সামান্য বণিকবিপণিতে এক পাত অষ্টাদশ মূল পাচনে দেখিবেন, কত বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন প্রদেশের মূল একত্রিত থাকে। কোন বিশেষ রোগের প্রতীকার জন্য সেইগুলি একত্রিত করিতে প্রাচীন পণ্ডিতগণের কত অধ্যবসায় এবং কত সময় লাগিয়াছে। কিন্তু যেরূপ তাড়িত গতিতে সমস্ত লোপ পাইতেছে, বোধ হয়, এইরূপে চলিলে পরে আর কিছুদিন কপিরাজ ও কবিরাজ শব্দে কেবল বর্ণগতও নয়, অর্থগতও অনেক সাদৃশ্য হইবে।
সঙ্গীত। সঙ্গীতের ক্রিয়াসিদ্ধের উৎকর্ষ দেখিয়া ও সূক্ষ্মরূপে আলোচনা করিয়া আমাদের বিশ্বাস যে, ভারতবর্ষে মুসলমানদিগের সময়ে অতি উন্নত সঙ্গীতবিজ্ঞান ছিল। সোমশ্বর, কাণামাঘ, হনূমত প্রভৃতি মতভেদ দেখিলে বিজ্ঞানের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ হয় বটে, কিন্তু শ্রীরাগে ও ভৈরবে কেহই সাদৃশ্য স্থাপন করেন নাই। করেন নাই কেন? বিজ্ঞান তৎসমুদায়কে পৃথক করিয়া দিয়াছিল, বিজ্ঞানবাক্য অলঙ্ঘনীয়। বৈজ্ঞানিক ভিন্ন এই প্রশ্নের কেহই উত্তর দিতে পারেন না। আধুনিক সঙ্গীত শাস্ত্রজ্ঞানাভিমানিদিগের মধ্যে আমরা অনেককে জিজ্ঞাসা করিয়াছি যে কেন এগুলিকে বিশুদ্ধ ও অন্যগুলিকে জঙ্গলা বলেন? যাঁহারা সূক্ষ্ম জ্ঞানী তাঁহাদের উত্তরের তাৎপর্য এই যে, এরূপ ভেদনির্দেশ আপ্তোদেশমূলক মাত্র। ইহা বৈজ্ঞানিকের উত্তর নহে। বৈজ্ঞানিক বিজ্ঞান ভিন্ন কাহাকেও ওস্তাদ স্বীকার করেন না। মাননীয় ওস্তাদের দোহাই দেখিয়া অত্যন্ত আক্ষেপের সহিত স্বীকার করিতে হইতেছে যে পূর্বতন অতি উন্নত সেই বিচিত্র সঙ্গীতবিজ্ঞান একেবারে লুপ্ত হইয়াছে।