জ্যোতিষ। জ্যোতিষ বিজ্ঞানশাস্ত্র বটে, কিন্তু প্রাচীন বেদাঙ্গ। সুতরাং ইহার প্রাচীনত্বে সন্দেহ করা ধৃষ্টতা ভিন্ন আর কি বলা যাইতে পারে? ব্রহ্মদেশীয় চন্দ্র সূর্য গ্রহণ তালিকা পঞ্জিকার প্রাচীনত্ব বিষয়ে ফরাসী ও বিলাতি পণ্ডিতগণের মধ্যে নানা বাগ্‌বিতণ্ডা হইয়াছে। অনেক বিদেশীয় পণ্ডিত, হিন্দুরা অতি প্রাচীন জাতি স্বীকার করা, স্বজাতির গৌরব হানিকর বিবেচনা করেন।

হিন্দুজাতি অথবা আর্যেরাই যে জ্যোতিষ্কগণের প্রথম পর্যবেক্ষক, নিয়মানুসন্ধায়ক ও তত্ত্বোদ্ভাবক, তাহা ভাষাবিজ্ঞানবিৎগণের অবশ্য স্বীকার্য। যে সপ্তর্ষি উল্লেখ পূর্বে করিয়াছি, তাহাকে ইয়ুরোপীয়গণ উর্ষ মেজর বা বৃহৎ ভল্লুক বলেন। প্রাচীন বেদেও সপ্তর্ষি শব্দের স্থলে ঋক্ষ (ভল্লুক) শব্দ ব্যবহার আছে। কেবল সংস্কৃত ভাষায় দেখা যায় যে ঋচ্ ধাতুর অর্থ দ্যুতি। ঐ তারা কয়টি অতিশয় উজ্জ্বল। উজ্জ্বলতা দেখিয়া দ্যুতিবাচক কোন নাম দিয়া পরে সেই নামের অর্থ ক্রমে ভল্লুক বোধ করা ও আকার সাদৃশ্য উপলব্ধি করা অত্যন্ত সঙ্গত বোধ হয়। ও এইরূপ করা কেবল আর্যগণেরই সম্ভব হইতে পারে।

হিন্দুরা দূরবীক্ষণ, অণুবীক্ষণ, আলোকবীক্ষণ প্রভৃতি কাচ যন্ত্রের সাহায্য ব্যতীত জ্যোতিষ চালনা করিয়া যে সফলতা লাভ করিয়াছিলেন, তাহা ভাবিলে বিস্ময়াপন্ন হইতে হয়। সামান্য নবদ্বীপপঞ্জিকা সেই বিজ্ঞানের ধ্বংসাবশেষ মাত্র।

দিবামান, রাত্রিমান, তিথিমান, নির্ণয়, চন্দ্রসূর্যের উদয়াস্ত নির্ধারণ—গ্রহ নক্ষত্র সঞ্চার ক্রিয়া স্থির করা, অয়ন গ্রহণ ও সংক্রমণ গণনা—সে সকল এখন অতি ভ্রমসঙ্কুল হউক না কেন, লুপ্তবিজ্ঞানের ধ্বংস চিহ্ন তাহার আর সন্দেহ নাই। এখন জীবিতবিজ্ঞান নাই, তাহার স্থানে কতকগুলি অকৃতজ্ঞ পিতৃমাতৃ শূন্য দুর্বল সঙ্কেত আছে মাত্র। বিজ্ঞান বলে আর্যভট্ট পৃথিবীর অক্ষরেখার তির্যকভাব অবধারণ করিয়াছিলেন ও তাহার পরিমাণ সার্ধ তেইশ অংশ নির্ধারণ করেন। আর এখনকার জ্যোতির্বিজ্ঞানাভিমানীরা সামান্য সূর্য গ্রহণ গণনায় এক দণ্ড বা দুই দণ্ড ভ্রম করিয়া বিজ্ঞানের পরিচয় প্রদান করিলেন। যদি বাপুদেব শাস্ত্রী না থাকিতেন, ত কি লজ্জার কথা হইত! ইচ্ছা ছিল, পূর্বোল্লিখিত বিজ্ঞানগুলি ক্রমে ক্রমে গ্রহণ করিয়া একে একে সকলগুলির বিস্তৃত বিবরণ প্রদান করি, প্রবন্ধের দৈর্ঘ্যভয়ে তাহা করিতে পারিলাম না। সংক্ষেপে দুই চারি কথা লেখা যাইতেছে।

বীজগণিত। কি করা কর্তব্য, স্থির করিতে না পরিয়া লোকে সচরাচর যে বলিয়া থাকে, “আমি অস্থিরপঞ্চে পড়িয়াছি।” সেই অস্থিরপঞ্চ বীজগণিতান্তর্গত এক প্রকার অঙ্ক। যে অঙ্ক প্রাচীন বীজগণিতে অতি শীঘ্র সমাধা হইতে পারে। আর যে অঙ্ক যুনানী দেশে দ্যোফান্ত প্রথম উদ্ভাবন করেন, ও সেইজন্য যাহাকে দ্যোফান্তীন বলে, যাহা সপ্তদশ শতাব্দীতে প্রথম সিদ্ধ হয়, তাহাও হিন্দুবীজগণিত মধ্যে আমরা শুনিয়াছি। যে দেশের দ্যোফান্তের বহু পূর্বে দ্যোফ্যান্তীন কূট সাধ্য হইত, সেই দেশীয় শৌভঙ্করিক বীরগণ সামান্য ভগ্নাংশে “এক পর্বতপ্রমাণ দেউল” দেখিয়া শ্লোকোক্ত বীর তাহা ভাঙ্গিতে সমর্থ হওয়া দূরে থাকুক, উদ্দেশ্য প্রমাণ করিয়া পলায়নপর হয়েন। (*) তথাপি আশা করিবার অনেক স্থল আছে, কেননা আবার সেই দেশেই দেখিতেছি যে দিল্লী কলেজে সুবিখ্যাত অধ্যাপক রামচন্দ্র স্বীয় অপূর্ব গ্রন্থ “গরিমা লঘিমা” প্রচার দ্বারা বিলাতীয় বিখ্যাতনামা ডিমরগণ বৈজ্ঞানিকেরও বিস্ময় উৎপাদন করিয়াছেন। ও ভূয়ো প্রশংসাবাদ আকর্ষণ করিয়া লইয়াছেন। ভরসা এই, যদি মরুভূমি মধ্যে আমরা এরূপ বটবৃক্ষ দেখিতে পাইলাম, তাহা হইলে কর্ষিত ক্ষেত্রে উৎসাহবারি সেচনে ভারতভূমি কল্পতরু বা কল্পলতাই উৎপাদন করিবে।

   (*) আছিল দেউল এক পর্বত প্রমাণ।
      ক্রোধ করি ভাঙ্গে তাহা পবন নন্দন ||
     অর্ধেক পঙ্কেতে তার তেহাই সলিলে।
     দশম ভাগের ভাগ সেবালার দলে ||
     উপরে বায়ান্ন গজ দেখ বিদ্যমান।
     করহ সুবোধ সবে দেউল প্রমাণ ||