সংযোজনী
আত্মতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞান। বেদান্তের সূক্ষ্ম গূঢ় ঈশ্বরতত্ত্ব (Theology) ও মায়াবাদমূলক অপূর্ব সংসারতত্ত্ব (Sensational Cosmology), কাপিল সাংখ্যের বেদান্তবিরোধী প্রকৃতিবাদ (Materialism), অক্ষপাদ গোতমের আণ্বীক্ষিকী দর্শন ও ন্যায় শাস্ত্র (Inductive Philosophy and Logic) এবং কণাদের পদার্থ-বিচার (Categorical analysis) এগুলি এক এক বিষয়ের চূড়ান্ত সীমা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। প্রতিনিধি ডাইরেক্টর উড্রো সাহেব নবদীপস্থ ন্যায়-শিষ্যগণের বিতণ্ডাস্মরণ করিয়া লিখিয়াছেন, “আহা, এই বিচারশক্তি কেবল ব্যাপ্তি অব্যাপ্তি অন্যান্যভাব বিতণ্ডার পরিচারিকা না হইয়া যেদিন বস্তুবিচারের সহধর্মিণী হইবে সেদিন কি শুভ দিন হইবে!” যে মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী আশীর্বাদ করিতেছেন, তাঁহাকে কে না নমস্কার করিবে? বিশেষতঃ উড্রো সাহেবকে বাঙ্গালির শুভানুধ্যায়ী বলিয়া সকলেই জানিতেন। আমরা তাঁহাকে নমস্কার করি।
এতদ্ভিন্ন আরো কত বিজ্ঞান ছিল, এখন লোপ পাইয়াছে। সামান্য ভূতের ওঝারা যে এক স্থানে শব্দ করিয়া, সেই শব্দ ভিন্ন ভিন্ন স্থানাগত শব্দের ন্যায় অনুভূত করাইতে পারে, একথা প্রায় সকলেই জানেন। কতক দূর শব্দবিজ্ঞান (Acoustics) জ্ঞান ব্যতীত এই শব্দানুকরণ বিদ্যার (Ventrilocution) আলোচনা অত্যন্ত দুরূহ বলিয়া বোধ হয়। হয়ত শব্দবিজ্ঞানের কোন স্থূল সত্য উদ্ভাবিত হইয়া থাকিবে। কিন্তু এসকল ছিল, চর্চা ছিল, মহা মহা পণ্ডিত সকল ছিলেন, এখন কি? এখন আক্ষেপের বিষয় এই যে আমাদের আলস্য দোষে, পারতন্ত্র্য দোষে, নানা দোষে, অনেকগুলিরই “প্রায় লোপ হইয়াছে, নামমাত্র অবশিষ্ট আছে।” জিজ্ঞাসা করি, আর কত কাল এভাবে যাইবে?
৩। পূর্বেই বলা হইয়াছে, বিজ্ঞান অবহেলা জন্য আমরা দিন ২ বিদেশীয় জাতিগণের আয়ত্তাধীন হইতেছি; বস্তুবিচারে অক্ষম হইয়া কদন্ন ভোজনে, অপেয় পানে, অপরিশুদ্ধ বায়ু সেবনে দিন দিন দুর্বল হইতেছি। চিকিৎসাশাস্ত্রে নিতান্ত অজ্ঞ হওয়ায় বৈদেশিক প্রথাগত চিকিৎসকগণের হস্তে পতিত হইয়া সর্বদাই জ্বর জ্বালায় কাতর থাকিতে হয়। বিজ্ঞানের ক্রমেই লোপ সম্ভাবনা। “সুতরাং এক্ষণে ভারতবর্ষীয়দের পক্ষে বিজ্ঞানশাস্ত্রের অনুশীলন করা নিতান্ত আবশ্যক হইয়াছে। ও তন্নিমিত্ত ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভা নামে একটি সভা কলিকাতায় স্থাপন করিবার প্রস্তাব হইয়াছে। এই সভা প্রধান সভারূপে গণ্য হইবে এবং আবশ্যক মতে ভারতবর্ষের ভিন্ন ভিন্ন অংশে ইহার শাখা-সভা স্থাপিত হইবে।” আমরা এই প্রস্তাবের কায়মনোবাক্যে অনুমোদন করিতেছি। অনুষ্ঠাতার মঙ্গল হউক, অনুষ্ঠান সফল হউক।
৪। “ভারতবর্ষীয়দিগকে আহ্বান করিয়া বিজ্ঞান অনুশীলন বিষয়ে প্রোৎসাহিত ও সক্ষম করা এই সভার প্রধান উদ্দেশ্য।” উদ্দেশ্য অতি মহৎ, তার আর সন্দেহ কি? “আর ভারতবর্ষ সম্পর্কীয় যে সকল বিষয় লুপ্তপ্রায় হইয়াছে” বা হইতেছে “তাহা রক্ষা করা” (যথা মনোরম ও জ্ঞানদায়ক প্রাচীন গ্রন্থ সকল মুদ্রিত ও প্রচারিত করা ইত্যাদি) সভার আনুষঙ্গিক উদ্দেশ্য।” কেবল পুস্তক মুদ্রণ ব্যতীত লুপ্তপ্রায় বিষয়ের অন্যবিধ রক্ষা করা আবশ্যক বোধে আমরা অনুষ্ঠানপত্রের অর্থাৎ শব্দের স্থানে যথা ও পরে ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করিলাম। উদাহরণ দেওয়া যাইতেছে ; যেমন বারাণসীস্থ মানমন্দিরের বৈজ্ঞানিক সংস্কার অথবা প্রাচীন যন্ত্র সকল বা যন্ত্রখণ্ড সকল সংগ্রহ করা, প্রাচীন মুদ্রা, দানফলক বা আদেশফলক সকল সংগ্রহ করা, লুপ্ত বিষয়ের রক্ষার জন্য এগুলি সকলই আবশ্যক। কিন্তু এতদ্ভিন্ন আরো অনেকগুলি আনুষঙ্গিক উদ্দেশ্য হইতে পারে, ও হওয়া উচিতও বোধ হইতেছে। ভারতবর্ষীয়দিগকে বিজ্ঞানে যত্নশীল করিতে হইবে, ও তাঁহারা যত্ন করিতেছেন কি না, তাহা সর্বদা দেখিতে হইবে। আর (কথাটা বলিতে কিন্তু লজ্জা হয়) তাঁহারা বিজ্ঞানে যত্ন করিয়া কিছু আর্থিক উপকার পাইতেছেন কি না তাহাও দেখিতে হইবে। সে বিষয়ে আমাদিগের যাহা বক্তব্য সমাজ স্থাপিত হইলে বলিব।