এখন “রত্নাকর হয়েছেন দাস, কুবের তাঁর আজ্ঞাকারী”—। দশানন সমরক্ষেত্রে দেবগণের সহায়তা পান নাই। বিদ্বানের সমরক্ষেত্রে স্বয়ং অগ্নিদেব লৌহগোলক বাহনে বিপক্ষদলে মহামার উৎপাদন করিতেছেন। তাহাতেই বলি কল্পিত রাবণাপেক্ষা আধুনিক বিদ্বানের প্রভুত্ব অধিকতর শ্লাঘনীয়। কবিগুরু বাল্মীকি কলিকালে পনুঃপ্রাদুর্ভূত হইয়া স্বয়ং বিদ্বানের নিকটে রামায়ণ পাঠ করিতেছেন। ভাষাবিজ্ঞান বলে বৈজ্ঞানিক মীনরূপী ভগবানের ন্যায় আবার বেদোদ্ধার করিতেছেন। বৈজ্ঞানিক ঈশ্বরের অবতার। রাবণগৌরবলোপী, প্রতাপশালী শিবিকর্ণ সদৃশ পরোপকারী পরমযোগীর ন্যায় দৃঢ় নিবিষ্ট, সর্বদাই হৃষ্ট ও সকল অবস্থাতেই সন্তুষ্ট।

এই বিজ্ঞান বলেই আধুনিক ইউরোপীয়গণ এই পৃথিবীতে একাধিপত্য স্থাপন করিয়াছেন। দেখুন, বিলাতে খাদ্য সামগ্রী অতি দুর্মূল্য, শ্রমোপজীবিগণ “আমার” বলিতে পারে, “আমার পূর্ব্বপুরুষের” বলিতে পারে, এমন বাসস্থান তাহাদের অনেকেরই নাই; বিলাতে কার্পাসতূলা এক ছটাক পরিমিত উৎপন্ন হয় না; হয় আমেরিকা; নয় ভারতবর্ষ হইতে বিলাতীয়েরা তূলা আমদানি করেন। অথচ যন্ত্র বিজ্ঞানের এমনি ক্ষমতা, মাঞ্চেষ্টরের তন্তুবায়েরা লজ্জাহীনা ভারতের লজ্জা নিবারণ করিতেছে। লাঙ্কাশ্বায়ের দুর্ভিক্ষ হইল, আর যে দেশে ঢাকা আছে, শান্তিপুর শিমলে কলমে আছে, বালুচর বাণারস আছে, মুঙ্গের পাটনা আছে, কালিকট কাশ্মীর আছে, মহীসুর অম্বর সহর আছে—সেই দেশে, যেখানে লক্ষ লক্ষ মণ তূলা প্রতি বর্ষে উৎপন্ন হয়, যেখানে তন্তুবায়কে লিপিকর ভাস্কর বা সূত্রধার অপেক্ষা অধিক শ্রদ্ধা করে, সেই দেশে, যে দেশের তন্তুজাত রোম সম্রাটের রাজপরিচ্ছদ ছিল, যে দেশের সহিত বস্ত্রবাণিজ্য ব্যবসায়ে ব্রতী থাকিয়া মধ্যকালে বিনিষনগর সমৃদ্ধিশালী হয়—সেই দেশে লাঙ্কাশায়েরে দুর্ভিক্ষ হইল বলিয়া হা বস্ত্র যো বস্ত্র শব্দে কর্ণ বধির হইয়া যাইতে লাগিল।

হা অদৃষ্ট! বিজ্ঞান অবহেলার এই ফল। বিজ্ঞানের সেবা করিলে বিজ্ঞান তোমার দাস, যে বিজ্ঞানকে ভজে, বিজ্ঞান তাহাকে ভজিবে। কিন্তু যে বিজ্ঞানের অবমাননা করে, বিজ্ঞান তাহার কঠোর শত্রু। মনে করুন, কোথাকার অন্নকষ্টে পরিচ্ছদকষ্ট হইল। ঐন্দ্রজালিক বিজ্ঞান স্বীয় অবমাননা জন্য এইরূপে বৈরসাধন করিল। এখন ভুক্তভোগী লোক শিক্ষাগ্রহণ কর।

অনেকে বলেন, ইউরোপীয়েরা কেবল বাহুবলে এই ভারতবর্ষে আধিপত্য স্থাপন করিয়াছেন। বাহুবলেই বলুন, আর যাহা বলুন, সে কথা কতক দূর সত্য, তাহার অনুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু একথাটিও অত্যুক্তি দোষে দূষিত কখনই বলা যাইতে পারে না যে ইউরোপীয়েরা বিজ্ঞানবলে এই ভারতবর্ষ জয় করিয়াছেন, বিজ্ঞান বলেই ইহা রক্ষা করিতেছেন। বিজ্ঞানেই সতত চালনা করিয়াই বিদেশীয় বণিকদিগকে ভারততীরে আনয়ন করেন, বিজ্ঞানই নানা যুদ্ধে সহায়তা করিয়াছিলেন—এখনও বিজ্ঞান মহায়সশকট বাহনে, তড়িৎতার সঞ্চালনে, কামান সন্ধানে, অয়োগোলক বর্ষণে এই বীরপ্রসূ ভারতভূমি হস্তামলকবৎ আয়ত্ত করিয়া শাসন করিতেছে। শুধু তাহাই নহে। বিদেশীয় বিজ্ঞানে আমাদিগকে ক্রমশঃই নির্জীব করিতেছে। যে বিজ্ঞান স্বদেশী হইলে আমাদের দাস হইত, বিদেশী হইয়া আমাদের প্রভু হইয়াছে। আমরা দিন দিন নিরুপায় হইতেছি। অতিথিশালায় আজীবনবাসী অতিথির ন্যায় আমরা প্রভুর আশ্রমে বাস করিতেছি। এই ভারতভূমি একটি বিস্তীর্ণ অতিথিশালা মাত্র।

দ্বিতীয় ধারার কথার প্রমাণার্থ তদুল্লিখিত শাস্ত্র সকলের কি প্রকার সমালোচনা ছিল, দেখা যাউক।