অনুষ্ঠান পত্রের সাতটি ধারা ক্রমে গ্রহণ করিয়া প্রত্যেক ধারা সম্বন্ধে আমাদের যাহা বক্তব্য, তাহা বলিব।

১। “বিশ্বরাজ্যের আশ্চর্য ব্যাপার সকল স্থিরচিত্তে আলোচনা করিলে অন্তঃকরণে অদ্ভুত রসের সঞ্চার হয়।”

নিদাঘ ঋতুতে নিশানাথহীনা নিশাকালে উচ্চ প্রাসাদোপরি উপবিষ্ট হইয়া— একবার গ্রহ নক্ষত্র তারকা বিকীরিত মন্দাকিনী মধ্য প্রবাহিত গগনপ্রাঙ্গণে দৃষ্টি উৎক্ষিপ্ত কর। সেই অমল নীলিমা, সেই অনন্তবিস্তৃতি, সেই অসংখ্য জ্বলন্ত বিন্দুপাতোজ্জ্বলীকৃতা শোভা, সেই অস্ফুট শ্বেত কলেবরা স্বর্গ মন্দাকিনী, এই সকল শোভা শোভিত দিগ্বলয় ব্যাপী সেই মহাগর্ভ ব্রহ্মাণ্ড কটাহ দেখিলে বিস্ময় পরিপূরিত মনে আপনা আপনি জিজ্ঞাসা করিবে, এগুলি কি? কোথা হইতে আসিল? কি নিয়মে আকাশে বিচরণ করিতেছে?

আধুনিক বিখ্যাতনামা দার্শনিকেরা বলেন, তোমার প্রথম প্রশ্নের অর্থ নাই। ঈশ্বরবাদীরা বলেন, তোমার দ্বিতীয় প্রশ্ন আস্তিকতার মূলসূত্র। তোমার শেষ প্রশ্ন যে বিজ্ঞান প্রবৃত্তিলতার প্রথমাঙ্কুর, তদ্বিষয়ে দুইমত নাই।

তুমি ভাবিতে লাগিলে, কি নিয়মে ইহারা আকাশে বিচরণ করিতেছে। ভাবিতে ভাবিতে এক দিনে, দুই দিনে, এক মাসে, দুই মাসে দেখিতে দেখিতে জানিতে পারিলে যে, ঐ আকাশে সকল নক্ষত্রই ভ্রমণশীল, কেবল একটীই স্থির। এই স্থির তারাটি ধ্রুবনক্ষত্র। সেটি সর্বদাই উত্তরে আছে। এত দিনে তুমি একটী সামান্য জ্যোতিষ নিয়ম পরিজ্ঞাত হইলে; সামান্য নিয়মপরিজ্ঞানেই কত মহৎ উপকার দর্শিতে পারে; দিগ্‌ভ্রান্ত পথিকের পক্ষে এই সামান্য সত্যটি অন্ধকার রাত্রিতে কত উপকার সাধন করে। এক্ষণে জটিল নিয়মে সকলের বিশিষ্ট জ্ঞান হইলে কত ফল দর্শিতে পারে।

কত ফল ফলিতেছে, তাহা ত আমরা এক্ষণে অহরহ প্রত্যক্ষ করিতেছি। কোন পূজ্যপাদ ব্যক্তি বিজ্ঞানবেত্তার সহিত রাবণ রাজার তুলনা করিয়া বিজ্ঞানের ক্ষমতার পরিচয় প্রদান করিয়াছেন। তিনি বলেন, মহর্ষি বাল্মীকি দোর্দণ্ড দশাননের অসীম প্রতাপ বর্ণনজন্য কবিকুশল কল্পনাবলে অমরগণকে তাহার দাসত্বে নিযুক্ত করিয়া লঙ্কাধিপতির প্রাধান্য স্থাপন করিয়াছেন, কিন্তু বিজ্ঞানবেত্তার প্রভুত্ব এই কল্পনা-প্রসূত রাবণের প্রতাপ অপেক্ষা সমধিক শ্লাঘনীয়। সত্য বটে, দশানন কোন দেবকে মালাকার কার্যে, কাহাকেও বা অশ্বসেবক কর্মে, কাহাকেও বা গৃহপরিষ্কারক দাস্যে, নানা কার্যে নানা দেবগণকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন, কিন্তু বিজ্ঞানবেত্তা কি করিতেছেন? তিনি বাষ্পরূপী ইন্দ্রদেবকে মহায়সশকটচালনে নিযুক্ত করিয়াছেন। দেবকন্যা ক্ষণপ্রভা তাঁহার প্রভা লুকাইয়া বিদ্বানের সম্বাদবাহিনীভাবে অবিরত সম্বাদ বহন করিতেছেন। অসীমতেজা প্রভাকর অন্তরালে থাকিয়া নিজকরে সহধর্মিণী ছায়ার সাহায্যে বৈজ্ঞানিক লিপিকর কার্যে ব্যপত আছেন। পৃথিবী দেবী, দিক্‌পাল বরুণ, পবনরাজ, সকলকেই তিনি দাসত্বে আবদ্ধ রাখিয়াছেন। তাঁহারা কখন বিদ্বানের ক্ষুন্নিবৃত্তি জন্য ময়দা ভাঙ্গিতেছেন, কখন শীত নিবারণ জন্য বস্ত্র বয়ন করিতেছেন, কখন কাগজ প্রস্তুত করিতেছেন, কখন ঔষধ প্রস্তুত করিতেছেন। কভু বা বিজ্ঞানবিৎকে স্কন্ধে করিয়া স্বর্গলোকে লইয়া যাইতেছেন। কখন পুস্তক মুদ্রিত করিয়া আনিয়া বিদ্বানকে উপঢৌকন দিতেছেন। কখন বা তাঁহার প্রমোদভবনে, রাজবর্ত্মে আলো জ্বালিতেছেন। কি বিদ্যালয়ে কি গৃহকার্যে কি বিচারালয়ে কি ধর্মমন্দিরে একাকী, সজন, অমরগণ, সকল কালেই সকল অবস্থাতেই বিজ্ঞানবিতের ক্রীতদাস। হরিদ্বারসাগর প্রবাহিতা ভাগীরথীকে ভগীরথ তাঁহার জন্যই অবনীতলে আনিয়াছিলেন। সেই ভাগীরথী তাঁহার জল পরিচারিকা, তাঁহার অভ্যর্থনা জন্য অগস্ত্য মুনি বিন্ধ্যাচলকে অবনত করিয়া থাকিতে বলিয়া গিয়াছেন। হিমাচল বিদ্বানের জন্যই স্বকীয় আগারে তুষার ভাণ্ডার রক্ষা করিতেছেন। বনস্পতিগণ তাঁহার জন্য ফলভার বহন করে। খনি তাঁহারি জন্য উদরে করিয়া বহু মূল্য ধাতু ধারণ করে।