অসম্পূর্ণ রচনা
ভিক্ষা
আমি ভাবিয়া চিন্তিয়া স্থির করিয়াছি, এ যাত্রা ভিক্ষা করিয়া কাটাইব। আমাদের দেশ-ভাল দেশ, ভিক্ষায় বড় মান ; যে নির্ব্বোধ, সে পরিশ্রম করুক, আমি ভিক্ষা করিব।
কেহ মনে করিবেন না যে, আমি অন্ধ, কি খঞ্জ, কি বধির, কি পীড়িত, কি দীনদুঃখী। এ দেশে ভিক্ষা করিতে সে সব আড়ম্বরের প্রয়োজন কি? ভিক্ষা করিলেই হইল।
কে ভিক্ষা না করে? দীন-হীন, ধনবানের নিকট ভিক্ষা করে, ধনবানও দীন-হীনের নিকট ভিক্ষা করে। বড় বড় প্রকাণ্ডোদর জমীদারেরা দুঃখী প্রজাদের কাছে ভিক্ষা করেন ; আজ পিতৃশ্রাদ্ধ, কাল পুত্রের যজ্ঞোপবীত, তার পরদিন কন্যার বিবাহ। প্রজার নিকট ভিক্ষা না করিলে এ সব কর্ম্মে মান থাকে কই? বড় বড় কুলীন, তাঁহারা স্ত্রীর কাছে ভিক্ষা করিয়া উদর পরিপূরণ করেন, নহিলে নবধা কুললক্ষণ উজ্জ্বল হয় না। বড় বড় অধ্যাপক আচার্য্য গোস্বামীরা ভিক্ষা করেন, নহিলে পরকালের কাজ হয় না। তাঁহারা একান্ত পরহিতৈষী সন্দেহ নাই।
কে ভিক্ষা না করে? আমাদের দেশে সকলেই ভিক্ষা করে, কেবল ভিক্ষুক বিশেষে আর ভিক্ষার সময় বিশেষে, ভিক্ষার বিশেষ বিশেষ নাম আছে মাত্র। জমীদারের ভিক্ষার নাম মাঙ্গন, তাঁহাদের অনুচরদিগের ভিক্ষার নাম পার্ব্বণী, ভব-পারাবারের ত্রাণকর্ত্তা গুরুবর্গের ভিক্ষার নাম প্রণামী, আত্মীয় সমতুল্য ব্যক্তির ভিক্ষার নাম বিদায়। বরযাত্রীর ভিক্ষার নাম গণ, বরের বাপের ভিক্ষার নাম পণ, যে গ্রামে বিবাহ সে গ্রামের ভদ্রলোকদিগের ভিক্ষার নাম ডেলাভাঙ্গানি, আর তাহাদের যুবতীদের – অবলাবালাদিগের ভিক্ষার নাম -সেজতোলানি। নাছোড়বন্ধ ব্রাহ্মণ ভিখারীর ভিক্ষার নাম বার্ষিক। যাঁহার বাড়ীতে ঠাকুরদেবতা আছেন, তাঁহার ভিক্ষার নাম দর্শনী। রাজরাজড়ার ভিক্ষার নাম নজর ; কেবল খঞ্জ দীন দুঃখীর ভিক্ষার নাম ভিক্ষা। না হবেই না কেন? তাহারা যে পরের ধন চাহিয়া লইবার বাসনা করে, তাহাদের এত বড় যোগ্যতা!
ভিক্ষা আমাদের সংস্কার। সকল জাতির একটা একটা বিশেষ সংস্কার থাকে ; আমাদের সংস্কার ভিক্ষা। জন্মগ্রহণ করিয়াই ভিক্ষা পাই, তারে বলি যৌতুক। তার পর অন্নপ্রাশন ; অন্নপ্রাশনেও যৌতুক। ব্রাহ্মণের তার পর উপনয়ন, উপনয়নে ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে না করিলে ব্রাহ্মণ হয় না। পরে বিবাহ, তখন সোণায় সোহাগা, নববধূর চাঁদমুখ দেখাইয়া ভিক্ষা লই। শেষ মৃত্যু ; সে ব্যাপারটায় বড় বাঁধাবাঁধি,-যম ছেড়ে দেয় না, সুতরাং পুত্র গলায় কাচা বাঁধিয়া আমাদের জন্য ভিক্ষায় বাহির হয়।
আমাদের চক্ষে ভিক্ষাবৃত্তির অপেক্ষা আর শ্রেষ্ঠ বৃত্তি নাই। সেই জন্য আমাদের পূজ্য-দেবতামধ্যে প্রধান-মহাদেবকে ভিখারী সাজাইয়াছি। আর বিষ্ণু বামন-অবতারে ভিক্ষা করিয়া ত্রিলোক রক্ষা করিলেন। এখনও কোন দেবমূর্ত্তি দর্শন করিতে গেলে ঠাকুরকে পয়সাটি না দিলে দর্শন মঞ্জুর হয় না। যখন বর্ণবিভাগ বদ্ধমূল হইল, তখন ইতর বর্ণ ইতর বৃত্তি অবলম্বন করিল ; যথা,-বৈশ্যে বাণিজ্য, ক্ষত্রিয়ে রাজত্ব, শ্রেষ্ঠ বর্ণ ব্রাহ্মণের বৃত্তিও শ্রেষ্ঠ হইল,-তিনি ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিলেন। অতএব ইহা স্থির যে, এ সংসারে ভিক্ষাই সার পদার্থ।