অসম্পূর্ণ রচনা
ভিক্ষায় আর এক সুখ আছে,-আদায়ের সুখ। খাতক যদি আমার কর্জ্জ শোধ না দেয়, তবে মহাকষ্ট ; তাহার নামে নালিশ করিতে হয়। প্রভু যদি বেতন না দেয়, তবে আরও জঞ্জাল ; উপায় নাই বলিলেই হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এমনই সুনীতি যে, ভিক্ষা আদায়ের নানা শাসন আছে। প্রজা যদি জমীদারকে ভিক্ষা না দেয়, জরিমানা কর-মিথ্যা নালিশ কর-চাল কাটিয়া উঠাইয়া দাও। শিষ্যযজমান যদি ব্রাহ্মণকে ভিক্ষা না দেয়, অভিসম্পাত কর-বেটার সবংশে নির্ব্বংশ দাও ; তাহাতেও না দেয়, পইতা ছেঁড়-আর একটা পইতা কিনিয়া পরিও ; ইচ্ছা হয় তেরাত্রি কর, পার যদি ত লুকাইয়া লুকাইয়া কিছু কিছু আহার করিও ; উনানে পা পুরিও, কিন্তু দেখো, উনানে যেন আগুন না থাকে। আর যদি ব্রাহ্মণ না হইয়া জাতি-ভিখারী হও, তবে ধণ্বা দিও, মারে কাটে দ্বার ছেড়ো না। শ্রাদ্ধের সময় ভিক্ষা করিতে গেলে, যার শ্রাদ্ধ তার নরক দেখাইতে ভুলিও না। পশ্চিম দেশে আর একটা প্রথা আছে, সেইটা সর্ব্বাপেক্ষা ভাল,-তাহারা ঝাঁটা মারিয়া ভিক্ষা করে ; পার ত দাতাকে প্রথমে সেইরূপ সমাদরসূচক অভ্যর্থনা করিও।
ব্রাহ্মণ-ভিখারী! তোমাকে আরও দুই একটা পরামর্শ দিবার আছে। তুমি ভিক্ষুক-পূজ্য ব্যক্তি, যাহার দান লইবে, তাহার সহিত একাসনে বসিও না-উচ্চাসনে বসিও ; সে ব্যক্তি দাতা বইত নয়, তোমার সমানস্পর্দ্ধী? দাতার যদি সহজে মন না ভিজে, তাহার মাথায় শ্রীচরণখানি তুলিয়া দিও ; ইহাতে কোন ক্রমেই সঙ্কোচ করিও না। ভিখারীর পাদপদ্ম কখন কখন কাদা, গোবর ও বিষ্ঠায় পরিপূর্ণ থাকে-তথাপি দাতার মাথায় সোণার কিরীট থাকিলেও তাহার উপর পদ স্থাপন করিতে সঙ্কোচ করিও না। তাহাতে কার্য্যোদ্ধার না হয়, ভ্রূভঙ্গী করিও-ফিরিয়া দাঁড়াইও ; আগে বলিও, “দেবে না কেন? তাহাতেও না দেয়, অভিসম্পাত করিও ; পুত্রগুলির অমঙ্গলটা আগে দেখাইও। তবু কিছু না দেয়, বাপ চৌদ্দপুরুষকে গালি দিয়া চলিয়া আসিও। কার্য্যোদ্ধারের আর এক উপায় আছে,-ডিপে-হাতে বৈদ্য, কি পাঁজি-হাতে এদৈবজ্ঞ ইত্যাদি লোকের দেখা পাইলে দুই চারিটি উদ্ভট কবিতা শিখিয়া রাখিও ; কষ্ট করিয়া অর্থ লিখিবার প্রয়োজন নাই। প্রথমে আসন গ্রহণ করিয়াই দুই একটা কবিতা ছাড়িও ; পরে উপস্থিত কথার সহিত সংলগ্ন বা অসংলগ্ন যা হোক একটা অর্থ করিয়া দিও। তসর কাপড়খানা আর ফোঁটার আড়ম্বরটা চাই, আর যখন তখন তেমনি দাঁও ফাঁদিয়া বসিও। সুদের সুদ ছাড়িও না,-শাস্ত্রসম্মত দানটা হইলে দক্ষিণাটা না এড়ায়। যদি শুনিতে পাও যে, অমুক বাবুদের বাড়ী একটা বড় ক্রিয়া, সেই সময় কালে গোহালের গরুগুলা বাহিরে বাঁধিয়া তথায় টোল ফাঁদিয়া বসিও ; মামাত পিসিতত ভাইগুলাকে সাধিয়া পাড়িয়া দিন দুই তথায় পুরিও। পরে পত্রখানা জুটিলে সভায় উপস্থিত হইও। দেখ, গ্রামের বার্ষিক সমাজিকগুলিন যেন না ফস্কায় ; সেটায় বড় মান। ফলাহারে কামাই দিও না ; ফলাহার করিতে বসিয়া পাত হইতে গোটাকতক সন্দেশ চুরি করিয়া রাখিও ; বিদ্যাটি ছেলেগুলিকে শিখাইও। দেখো, চিঁড়ে দইয়ের ফলাহারে নুন মাখিতে ভুলে যেও না। কণ্ঠায় কণ্ঠায় ফলাহারের সমাপ্ত করিয়া আচমনের পর খড়িকা খাইতে খাইতে বলিও, “এত কপালে ছিল, পাষণ্ড বেটার বাড়ী আহার করিতে হইল।” এমন কথা দুটা একটা না বলিলে পাছে লোকে বলে তুমি পেটের দায়ে ফলাহার করিতে গিয়াছিলে।
-‘বঙ্কিম-জীবনী’, ৩য় সং, পৃ. ৩৬৫-৬৮।