বনময় পথ দিয়া যাইতে প্রভাতবাতাহত পদ্মের ন্যায় মাতঙ্গিনীর শরীর কম্পিত হইতে লাগিল। সর্ব্বত্র নিঃশব্দ; মাতঙ্গিনীর পাদবিক্ষেপশব্দ প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল; স্থানে স্থানে নিবিড় ছায়ান্ধকারে অন্তঃকরণ শিহরিতে লাগিল। যত বৃক্ষের গুঁড়ি ছিল প্রত্যেককে করালবদন পৈশাচ মূর্ত্তি বলিয়া ভ্রম হইতে লাগিল, বৃক্ষে বৃক্ষে, শাখায় শাখায়, পত্রে পত্রে, নরঘ্ন প্রেত লুক্কায়িতভাবে মাতঙ্গিনীকে লক্ষ্য করিতেছে তাহা তাঁহার প্রতীতি হইতে লাগিল। যে যে স্থলে তমসা নিবিড়তর, সেই সেই স্থানে দুরন্ত ভূতযোনী বা দস্যুর প্রচ্ছন্ন শরীরের ছায়া মাতঙ্গিনীর চক্ষুর্জ্বালা উৎপাদন করিতে লাগিল। বাল্যকালে যত ভৌতিক উপন্যাস শ্রুত হইয়াছিল, নিশীথ পান্থের গহনমধ্যে বিকট পৈশাচ দংষ্ট্র ভঙ্গী সন্দর্শনে ভীতি-বিহ্বল হইয়া প্রাণত্যাগ করার যে সকল উপকথা শ্রবণ করিয়াছিলেন, সে সকলই একেবারে তাঁহার স্মরণপথে আসিতে লাগিল।

যদি কোথাও শাখাচ্যুত শুষ্কপত্র-পতন শব্দ হইল, যদি কোনও শাখারূঢ় নৈশ বিহঙ্গ পক্ষস্পন্দন করিল, যদি কোথাও শুষ্কপত্রমধ্যে কোন কীট দেহ সঞ্চালন করিল, অমনি মাতঙ্গিনী ভয়ে চমকিয়া উঠিতে লাগিলেন; তথাপি দৃঢ় সঙ্কল্প-বিবদ্ধা সাহসিকা তরুণী, কখন বা ইষ্টদেব নামজপ কখন বা প্রিয়জনগনের বিপত্তি চিন্তা করিতে করিতে চঞ্চলপদে উদ্দিষ্ট স্থানাভিমুখে চলিলেন।

ভয়সঙ্কুল নিবিড় তমসাচ্ছন্ন পথের এক পার্শ্বে বৃহৎ আম্র-কানন অপর পার্শ্বে এক দীর্ঘিকার পাহাড়। বন্য উচ্চভূমিখণ্ডমধ্যে পথ অতি সঙ্কীর্ণ; তদুপরি দীর্ঘিকার উপর প্রকাণ্ডাকার কতিপয় বটবৃক্ষের ছায়ায় চন্দ্রালোকের গতি নিরুদ্ধ হইয়াছিল, সুতরাং এই স্থানে পথান্ধকার নিবিড়তর। দীর্ঘিকার পাহাড়ের বটবৃক্ষতল বহুতর লতাগুল্ম কণ্টক বৃক্ষাদিতে সমাচ্ছন্ন।

মাতঙ্গিনী ভীতি-চকিতনেত্রে ইতস্ততঃ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। আম্র-কাননের মধ্যে একটা প্রচণ্ড আলোক প্রদীপ্ত হইতেছিল, এবং অস্ফুটস্বরে বহু ব্যক্তির কথোপকথনের শব্দও মাতঙ্গিনীর কর্ণগোচর হইল।

মাতঙ্গিনী বুঝিলেন, যাহা ভর করিয়াছিলেন, তাহাই ঘটিল। এই আম্র-কাননের মধ্যে দস্যুদল জটলা করিতেছে। দুঃসময়ে বিপদ্ এক প্রকারে কেবল উপস্থিত হয় না;-পথিমধ্যে একটা কুকুর শয়ন করিয়াছিল, নিশাকালে পথিক দেখিয়া উচ্চরব করিতে লাগিল। আম্র-কাননের কথোপকথন তৎক্ষণাৎ বন্ধ হইল। মাতঙ্গিনী বুঝিতে পারিলেন যে, কুকুর-শব্দে দুরাত্মারা লোকসমাগত অনুভূত করিয়াছে; অতএব শীঘ্রই তাহারা কাছে আসিবে। আসন্নকালে মাতঙ্গিনী নিঃশব্দ গমনে দীর্ঘিকার জলের নিকট আসিয়া দাঁড়াইলেন। আম্র-কানন বা পথ হইতে তাঁহাকে কেহ দেখিতে পাইবার সম্ভাবনা রহিল না। কিন্তু যদি দস্যুরা দীর্ঘিকার তটারোহণ করিয়া পথিকের অণ্বেষণ করে, তাহা হইলে মাতঙ্গিনী তৎক্ষণাৎ দৃষ্টিপথে পতিত হইবেন। নিকটে এমত কোন ক্ষুদ্র বৃক্ষলতাদি ছিল না যে, তদন্তরালে লুক্কায়িত হইতে পারেন। কিন্তু আসন্ন বিপদে মাতঙ্গিনীর ধৈর্য্য ও কর্ত্তব্যতৎপরতা বিশেষ স্ফূর্ত্তি প্রাপ্ত হইয়া উঠিল।

ক্ষণমধ্যে মাতঙ্গিনী জলতীরস্থ এক খণ্ড গুরুভার আর্দ্র মৃৎখণ্ড উত্তোলন করিয়া অঙ্গস্থ শয্যোত্তরচ্ছদের মধ্যে রাখিয়া গ্রন্থিবন্ধন করিলেন। অনায়াস-গোপনযোগ্য পরিধেয় শাটীমাত্র অঙ্গে রাখিয়া কৃতপ্রতিজ্ঞ হইয়া দণ্ডায়মান রহিলেন। এক্ষণে পুষ্করিণীর পাহাড়ের অপর দিকে মনুষ্যকণ্ঠস্বর স্পষ্ট শ্রুতিগোচর হইল, এবং মনুষ্যসঞ্চালনশব্দও নিঃসন্দেহে শ্রুত হইল। মাতঙ্গিনী ঈদৃশ সাবধানতার সহিত শয্যোত্তরচ্ছদ জলমগ্ন করিলেন যে, জলশব্দ না হয়। বস্ত্রখণ্ড মৃৎখণ্ডের গুরুভারে তলস্পর্শ করিয়া অদৃশ্য হইল। মাতঙ্গিনী এক্ষণে ধীরে ধীরে জলমধ্যে অবতরণ করিয়া অন্ধকারবর্ণ স্বচ্ছ সরোবর-বক্ষে যথায় কথিত বটবিটপীর ছায়ায় প্রগাঢ়তর অন্ধকার হইয়াছিল, তথায় অধর পর্য্যন্ত জলমগ্ন হইয়া রহিলেন। তাঁহার মুখমণ্ডল ব্যতীত আর কিছু জলের উপর জাগিতেছিল না। তথাপি কি জানি, যদি সেই মুখমণ্ডলের উজ্জ্বলবর্ণ সে নিবিড় অন্ধকার মধ্যে কেহ লক্ষ্য করে, এই আশঙ্কায় মাতঙ্গিনী নিজ কবরীবন্ধনী উন্মোচন করিয়া কোমলকুঞ্চিত কুন্তলজাল মুখের উপর লম্বিত করিয়া দিলেন। অতঃপর সেই ঘনান্ধকারবর্ণ সরসীজলের উপরে, ঘনতর বৃক্ষ-ছায়াভ্যন্তরে যে নিবিড় কেশদাম ভাসিতেছিল তাহা মনুষ্য কর্ত্তৃক আবিষ্কৃত হওয়া অসম্ভব। পরক্ষণেই কথোপকথনকারীরা দীর্ঘিকা-তট অবতরণ করিয়া অর্দ্ধপথ আসিল। মাতঙ্গিনী তাহাদের কেবলমাত্র কণ্ঠস্বর ও পদশব্দ শুনিতে পাইলেন। তাহাদের পানে যে চাহিয়া দেখিবেন, এমত সাহস হইল না।