আগন্তুকদের মধ্যে একজন অর্দ্ধস্ফুট বাক্যে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে কহিল, “এ ত বড় তাজ্জব! আমি সঠিক বলিতেছি, আমি বেশ দেখিয়াছিলাম, এই পথের উপর একটা মানুষ চাদর মুড়ি দিয়া যাইতেছিল; বাগানের বেড়ার ফাঁক দিয়া আমি দেখিয়াছিলাম।”

দ্বিতীয় ব্যক্তি কহিল, “গাছপালা দেখে তোর ধাঁধা লেগে থাক্‌বে; অপদেবতা টেবতাই বা দেখে থাক্‌বি। এত গর্‌মিতে মানুষে কাপড় মুড়ি দিয়া বেড়াবে কেন?”

“হবে” বলিয়া পুনশ্চ উভয়ে ইতস্ততঃ নিরীক্ষণ করিয়া দেখিল ; আশঙ্কার মূল কারণ যে ভীতিবিহ্বলা অবলা তাঁহাকে তাহারা দেখিতে পাইল না।

দস্যুরা কিছু দেখিতে না পাইয়া চলিয়া গেল। যতক্ষণ তাহাদের প্রত্যাবর্ত্তন-শব্দ কর্ণগোচর হইতে লাগিল ততক্ষণ মাতঙ্গিনী জলমধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত করিয়া স্থিরভাবে দণ্ডায়মান রহিলেন। যখন বিবেচনা হইল যে, আর তাহাদের দেখিতে পাইবার সম্ভাবনা নাই, তখন জল হইতে উঠিয়া গমনোদ্যোগিনী হইলেন।

মাতঙ্গিনী যে পথে গমনকালীন এরূপ বিপদ্‌গ্রস্ত হইয়াছিলেন, শঙ্কাক্রমে এবার সে পথ ত্যাগ করিলেন। পুষ্করিণীর তীর পরিবেষ্টন করিয়া অপর দিকে এক পথে উঠিলেন। মধুমতী যাইতে মাতঙ্গিনীর নিষেধ ছিল বটে, কিন্তু পুষ্করিণী নিষিদ্ধ ছিল না, এবং মধ্যে মধ্যে আহ্নিক স্নানাদি ক্রিয়ার্থ এই জলে আসিতেন। সুতরাং এ স্থানের সকল পথ উত্তমরূপে চিনিতেন। পুষ্করিণীর অন্য এক পাহাড়ে উঠিয়া অন্য এক পথ অবলম্বন করিলে যে পূর্ব্বাবলম্বিত পথে পড়িতে হয়, অথচ আম্র-কাননের ধারে যাইতে হয় না, ইহা এই সময়ে মাতঙ্গিনীর স্মরণ হইল। বৃক্ষলতাকণ্টকাদির প্রাচুর্য্য বশতঃ এই পথ অতি দুর্গম, কিন্তু মাতঙ্গিনীর পক্ষে কণ্টকাদির বিঘ্ন, তুচ্ছ বিঘ্ন অলক্তক পরিবর্ত্তে কণ্টক-বেধবাহিত রক্তধারা চরণদ্বয় রঞ্জিত করিতে লাগিল। এক দিকে গুরুতর সঙ্কল্প সিদ্ধির জন্য উৎকণ্ঠা, অপর দিকে দস্যু-হস্ত হইতে পরিত্রাণের জন্য ব্যগ্রতা; এই উভয় কারণে মাতঙ্গিনী তিলার্দ্ধ বিলম্ব না করিয়া কণ্টকলতাদি পদদলিত করিয়া চলিলেন। কিন্তু এক নূতন ব্যাঘাত উপস্থিত হইবার উপক্রম হইল;-মাতঙ্গিনী রাধাগঞ্জে আসিয়া অবধি দুই তিনবার মাত্র সহোদরাবল্লভ মাধবের আলয়ে আগমন করিয়াছিলেন, কিন্তু পদব্রজে একবারও গমন করেন নাই। সুতরাং এদিকের পথ তাঁহার তেমন জানা ছিল না। এক্ষণে মাতঙ্গিনী চতুর্দ্দিকবাহী পথ-সন্নিধানে উপনীতা হইয়া কোন্ পথে যাইবেন, তাহা অবধারণে অক্ষম হইলেন। মাতঙ্গিনী পাগলিনীর ন্যায় ইতস্ততঃ চাহিতে লাগিলেন। ভাগ্যক্রমে মাধবের অট্টালিকার সম্মুখ-রোপিত দেবদারু-শ্রেণীর শিরোমালা নয়নগোচর হইল। দৃষ্টিমাত্র হর্ষিতচিত্তে তদভিমুখে চলিলেন; এবং সত্বর অট্টালিকার সমীপবর্ত্তিনী হইয়া খিড়কির দ্বারে উপস্থিত হইলেন। তথাপি মাতঙ্গিনীর ক্লেশের চূড়ান্ত হইল না। এ নিশীথে বাটীর সকলেই নিদ্রিত, কে দ্বার খুলিয়া দিবে? অনেকবার করাঘাত করিয়া মাতঙ্গিনী পুরকিঙ্করী করুণাকে নিদ্রোত্থিতা করিলেন। নিদ্রাভঙ্গে করুণা অপ্রসন্ন হইয়া ভীষণ গর্জ্জন করিয়া কহিল, “এত রেতে কে রে দোর ঠেঙ্গায়?”

মাতঙ্গিনী উৎকণ্ঠা-তীব্র স্বরে কহিলেন, “শীঘ্র-শীঘ্র করুণা, দ্বার খোল।” নিদ্রাভঙ্গকরণ-অপরাধ অতি গুরুতর ; এমন সহজে ক্ষমা সম্ভাবনা কি? করুণার ক্রোধোপণম হইল না, পূর্ব্ববৎ পুরুষ বচনে কহিল, “তুই কে যে তোকে আমি তিন পর রেতে দোর খুলে দেব?”

মাতঙ্গিনী স্পষ্টে আপন নাম ডাকিয়া কহিতে পারেন না, অথচ শীঘ্র গৃহ-প্রবেশ জন্য ব্যস্ত হইয়াছেন; অতএব পুনরায় সবিনয়ে কহিলেন, “তুমি এস শীঘ্র এসো গো, এলেই দেখ্‌তে পাবে।”

করুণা সম্বর্দ্ধত রোষে কহিল, “তুই কে বল্ না, আ মরণ‌!”

মাতঙ্গিনী কহিলেন, “ওগো বাছা, আমি চোর ছ্যাঁচড় নই, মেয়ে মানুষ।”

তখন করুণার স্থূল বুদ্ধিতেও একটু একটু আভাস হইল যে, চোর ছ্যাঁচড়ের কণ্ঠস্বর এত সুমধুর প্রায় দেখা যায় না। অতএব আর গণ্ডগোল না করিয়া দ্বার খুলিয়া দিল। এবং মাতঙ্গিনীকে দেখিবামাত্র সাতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিল, “এ কি! তুমি! তুমি ঠাকুরাণী!”

মাতঙ্গিনী কহিলেন, “আমি একবার হেমের সঙ্গে দেখা করিব-বড় দরকার; শীঘ্র আমাকে হেমের কাছে লইয়া চল।”