অসম্পূর্ণ রচনা
কনক নিস্পন্দ ও নির্ব্বাক্ হইল। মাতঙ্গিনী দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন, এবং পুনরায় গভীর চিন্তায় অভিভূত হইলেন। ভাবিলেন, “কি করি? কেমন করে তাদের রক্ষা হয়? কে সংবাদ দিবে?-কে এ রাত্রে যাইবে? আমি আপনিই যাই, এ ছাড়া অন্য উপায় নাই।” পরক্ষণে ভাবিলেন-“কেমন করিয়া যাইব? লোকে কি বলিবে? মাধব কি মনে করিবে? শুধু তাহাই নহে, স্বামী জানিতে পারিলে প্রমাদ ঘটিবে। তাহা হউক-লোকে যাই বলুক-মাধব যাহা হয় মনে করুক-স্বামী যাহা করে করুক, তজ্জন্য মাতঙ্গিনী ভীতা নহে।”
কিন্তু মাতঙ্গিনী যাইতে সাহস করিলেন না। এ গভীর নিশীথকালে, এই নিস্তব্ধ বনান্ত পথ, তাহাতে আবার একাকিনী অবলা, নবীন বয়সী, বাল্যকালাবধি ভৌতিক উপন্যাস শ্রবণে হৃদয়মধ্যে ভৌতিক-ভীতি বিষম প্রবলা। পথ অতি দুর্গম। তাহাতে আবার দস্যুদল কোথায় জটলা করিয়া আছে; যদি তাহাদের করকবলিত হয়েন? এই কথা স্মৃতিমাত্র ভয়ে মাতঙ্গিনীর শরীর রোমাঞ্চিত হইল। যদি দস্যুদলমধ্যে মাতঙ্গিনী স্বামীর দৃষ্টিপথে পতিতা হয়েন? এই ভয়ে মাতঙ্গিনী পুনঃ পুনঃ রোমাঞ্চিত হইতে লাগিলেন।
স্বভাবতঃ মাতঙ্গিনীর হৃদয় সাহস-সম্পন্ন। যে অন্তঃকরণে স্নেহ আছে, প্রায় সে অন্তঃকরণে সাহস বিরাজ করে। প্রিয়তমা সহোদরা ও তৎপ্রতির মঙ্গলার্থ মাতঙ্গিনী প্রাণ পর্য্যন্ত দিতে উদ্যত হইলেন। যেমন উপস্থিত বিপত্তির বিকট মূর্ত্তি পুনঃ পুনঃ মনোমধ্যে প্রকটিত হইতে লাগিল, অমনি মাতঙ্গিনীও হৃদয়গ্রন্থি দৃঢ়বদ্ধ হইতে লাগিল-তখন অগাধ প্রনয়-সলিলে ভাসমান হইয়া বলিলেন, “এ ছার জীবন কার আর কি জন্য? যদি এ সঙ্কল্পে প্রাণ রক্ষা না হয়, তাতেই বা ক্ষতি কি? এ গুরুভার বহন করা আমার পক্ষে কষ্টকর হইয়াছে। কাজেই এ দেহ ত্যাগ করিতে ইচ্ছা করে। যাহারা প্রাণাধিক্ তাহাদের মঙ্গল সাধনে এ প্রাণ ত্যাগ না করি কেন? আমার ভয় কি? প্রাণনাশাধিক বিপদও ঘটিতে পারে; জগদীশ্বর রক্ষাকর্ত্তা।”
কিন্তু মাধবের বাটীতে এ নিশীথে একাকিনী কি প্রকারেই যান? মাতঙ্গিনীর চিন্তাকুলতা সহনানীত হইল।
কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া মাতঙ্গিনী দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া চিন্তাসম্বর্দ্ধিত গ্রীষ্মাতিশয্যের প্রতিকার হেতু জালরন্ধ্র সন্নিধানে গিয়া জালাবরণী উত্তোলন করিলেন। দেখিলেন যে, বিটপী শ্রেণীর ছায়া এক্ষণে দীর্ঘাকৃত হইয়াছে-অস্তাচলাভিমুখী নিশাললাটরত্ন প্রায়-দিগন্তব্যাপী বৃক্ষশিরোরাজির উপরে আসিয়া নির্ব্বাণোন্মুখ আলোক বর্ষণ করিতেছেন। আর দুই চারি দণ্ড পরে সে আলোক একেবারে নির্ব্বাপিত হইবে; তখন আর হেমাঙ্গিনীকে রক্ষা করিবার সময় থাকিবে না। বিপদ্ একেবারে সম্মুখে দেখিয়া মাতঙ্গিনী আর বিলম্ব করিলেন না।
মাতঙ্গিনী ঝটিতি এক খণ্ড শয্যোত্তরচ্ছদে আপাদমস্তক দেহ আবরিত করিলেন, এবং কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্তা হইয়া যে কৌশলপ্রভাবে ক্ষণপূর্ব্বে রাজমোহন বাহির হইতে দ্বার রুদ্ধ করিয়াছিলেন, মাতঙ্গিনীও তদ্রূপ করিলেন।
গৃহের বাহিরে দণ্ডায়মানা হইয়া যখন মাতঙ্গিনী ঊর্দ্ধে অসীম নীলাম্বর, চতুর্দ্দিকে বিজন বন-বৃক্ষের নিঃশব্দ নিস্পন্ত্র শিরঃশ্রেণীর নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন, তখন পুনর্ব্বার সাহস দ্রবীভূত হইয়া গেল-হৃদয় শঙ্কাকম্পিত হইল-চরন অচল হইল। মাতঙ্গিনী অঞ্জলিবদ্ধ করে ইষ্টদেবের স্তব করিলেন। হৃদয়ে আবার সাহস আসিল; তিনি দ্রুতপাদবিক্ষেপে পথ বহিয়া চলিলেন।