জানিয়াই বা কি? দস্যু-স্পর্শ হইতে পলাইবার উপায় আছে কি? স্ত্রী-জাতি-পতিসেবাপরায়ণা দাসী-পতিত্যাগের শক্তি কোথায়? চিরদিন দস্যুপদে দেহ-রত্ন অর্পিত হইবে-গরলোদ্গীর্ণমান বিষধর হৃদয়-পথে আসীন থাকিবে, পাছে সে আন্দোলনে আসনচ্যুত হয় বলিয়া কখন দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিতে পারিবে না। ইহা অপেক্ষা আর কি ভয়ঙ্কর ললাট-লিপি বিধাতার লেখনী হইতে নির্গত হইতে পারে?

মাতঙ্গিনী ক্ষণেককাল এইরূপ চিন্তা করিলেন; পরক্ষণেই যে দস্যুদল-সঙ্কলিত দারুণপ্রমাদ ঘটনা হইবে তাহাই মনোমধ্যে প্রখর তেজে প্রদীপ্ত হইতে লাগিল। আর কাহারই বা এই সর্ব্বনাশ ঘটনা হইবে? হেমাঙ্গিনীর সর্ব্বনাশ, মাধবের সর্ব্বনাশ! মাতঙ্গিনীর শরীর রোমাঞ্চ কণ্টকিত,-শোণিত শীতল হইতে লাগিল, মস্তক বিঘূর্ণিত হইতে লাগিল। যখন ভাবিলেন যে প্রিয় সহোদরা এক্ষণে এই নির্জ্জন নিশীথে হৃদয়বল্লভের কণ্ঠলগ্না হইয়া নিশ্চিন্ত মনে সুষুপ্তি সুখানুভব করিতেছে, সে মনেও জানে না যে, দারিদ্র্যরাক্ষসী তাহার পশ্চাতে মুখব্যাদান করিয়া রহিয়াছে, এখনই গ্রাস করিবে; হয়ত ধনহানির সঙ্গে মানহানি, প্রাণহানি পর্য্যন্ত হইবে তখনই মাতঙ্গিনীর নিজ সম্বন্ধীয় মর্ম্মব্যথক ভূত ভবিষ্যত চিন্তা অন্তর্হিত হইল। মনে মনে স্থির বুঝিলেন যে, আমি না বাঁচাইলে হেমাঙ্গিনী ও মাধবের রক্ষা নাই, যদি প্রাণ পর্য্যন্ত পণ করিয়া তাহাদের রক্ষা করিতে পারি, তবে তাহাও করিব।

মাতঙ্গিনী প্রথমোদ্যমে মনে করিলেন, গৃহস্থ সকলকে জাগরিত করিয়া সকল ঘটনা বিবৃত করেন, কিন্তু তৎক্ষণাৎ সে ভাব অন্তর্হিত হইল; ভাবিলেন, তাহাতে কোন উপকার হইবে না। কেন না, রাজমোহনের আত্মপরিবার এমত অশ্রুতপূর্ব্ব সংবাদ বিশ্বাস হইবেক না; বিশ্বাস করিলেও মাধবের উপকারার্থ রাজমোহনের বিরুদ্ধাচারী হইবেক না। বরং লাভের মধ্যে তাহারা রাজমোহনের নিকট মাতঙ্গিনীকে এতদ্বিষয়ে সংবাদ-দাত্রী বলিয়া পরিচিত করিলে মাতঙ্গিনীর মহাবিপদ্ সম্ভাবনা।

পশ্চাৎ বিবেচনা করিলেন যে, কেবল কনককে জাগ্রত করিয়া তাহাকে সকল সংবাদ অবগত করান; এবং যাহা উচিত হয় পরামর্শ করেন। তদভিপ্রায়ে মাতঙ্গিনী শয্যাত্যাগ করিয়া বাটীর বাহিরে আসিলেন। কনকের গৃহ সন্নিকট। মাতঙ্গিনী ধীরে ধীরে কনকের গৃহাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন।

চন্দ্রালোকে পৃথিবী প্রফুল্লিতা। মাতঙ্গিনী কনকের গৃহ দ্বারে উপনীত হইয়া ধীরে ধীরে করাঘাত করিলেন, কনকের নিদ্রাভঙ্গ হইতে না হইতে কনকের মাতা কহিল, “কে রে?”

সর্ব্বনাশ! কনকের মাতা অতিশয় মুখরা, মাতঙ্গিনীর এ কথা স্মরণই ছিল না। মাতঙ্গিনী ভয়ে নিঃশব্দ রহিলেন। কনকের মাতা পুনঃ পুনঃ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে রে?” “কে রে?”

মাতঙ্গিনী সাহস করিয়া কম্পিত কণ্ঠে বলিল, “আমি গো।”

কনকের মাতা কোপযুক্ত স্বরে কহিল, “কে?-রাজুর বৌ বুঝি, এত রাত্রে তুমি এখানে কেন গা?”

মাতঙ্গিনী মৃদুস্বরে বলিলেন, “কনককে একটা কথা বলিব।”

কনকের মাতা বলিল, “রাত্রে কথা কি আবার একটা? সারাদিন কথা কয়ে কি আশ মেটে না? ভালমানুষের মেয়েছেলে রাত্রে এ-বাড়ী ও-বাড়ী কি গা? বউ-মানুষ, এখনই এ সব ধরেছ?-চল দেখি তোমার পিশেসের কাছে।”

মাতার তর্জ্জনে গর্জ্জনে কনকের নিদ্রাভঙ্গ হইল; বৃত্তান্ত বুঝিয়া কনক কহিল, “মা, দুয়ারটা খুলে দাও, শুনিই না কি বলে।”

কনকের মাতা গর্জ্জন করিয়া বলিল, “দেখ্ কন্‌কি, এমন মুড়ো ঝাঁটা তোর কপালে আছে।”