অসম্পূর্ণ রচনা
দস্যু। কহিল, “হুঁ, কিন্তু উইলখানা কোথায় আছে আমরা তা জানি না। আমরা ত সমস্ত রাত্রি কেবল কাগজ উটকাইয়া বেড়াইতে পারব না। কোথায় আছে সে খবরটা তুমি অবশ্য জান।”
রাজ। জানি; কিন্তু কাহার জন্য উইল চাই?
দস্যু। তাহা কেন বলিব?
রাজ। কেন, আমাকেও বলিবে না?-আমার কাছে লুকাইবার আবশ্যক?
দস্যু। তোমাকেও বলিতে বারণ।
রাজ। মথুর ঘোষ?
দস্যু। যেই হউক-আমাদের বাদশার মুখ নিয়ে কাজ। যেই হউক, কিছু মজুরি দেবে, আমরা কাজ তুলে দেব।
রাজ। আমারও ঐ কথা।
দস্যু। উইল পাব কোথায়?
রাজ। আমায় কি দিবে বল?
দস্যু। তুমি বল না।
রাজ। পাঁচ শত খানি দিও; তোমরা পাবে ঢের, দিলেই বা।
দস্যু। এটা বড় জিয়াদা হইতেছে; আমরা মোটে দুই হাজার দক্ষিণা পাইব, তার মধ্যে সিকি দিই কেমন করে।
রাজ। তোমাদের ইচ্ছা।
দস্যু। পুনর্ব্বার চিন্তা করিয়া কহিল, “আচ্ছা, তাই সই; আমার ঢের কাজ আছে, আমি কাগজ হাঁটকাইয়া বেড়াইলে চলিবে না। নয়ত কোনও ছোঁড়া ফোঁড়ার হাতে পড়িবে, আর পুড়াইয়া ফেলিবে-পাঁচ শতই দেব।”
রাজ। মাধবের শুইবার খাটের শিয়রে একটা নতুন দেরাজ-আলমারি আছে; তাহার সব নীচের দেরাজের ভিতর একটা বিলিতী টিনের ছোট বাক্সতে উইল, কবালা, খত ইত্যাদি রাখিয়া থাকে; আমার গোপন খবর জানা আছে।
দস্যু। ভাল কথা; যদি এ লেঠা চুকিল, তবে চল জুটি গিয়া। কর্ম্ম হইয়া গেলে যেখানে আসিয়া তোমার সঙ্গে দেখা করিব, তাহা সকলে থেকে স্থির করা যাইবে। এস, আর দেরি করে কাজ নেই; চাঁদনি ডুবিলে কর্ম্ম হবে-এখনকার রাত ছোট।
এই কহিয়া উভয়ে ধীরে ধীরে গৃহের ছায়াবরণ হইতে বনের দিকে প্রস্থান করিল। মাতঙ্গিনী বিস্মিত ও ভীতি-বিহ্বলা হইয়া ভূতলে বসিয়া পড়িলেন।
নবম পরিচ্ছেদ
মাতঙ্গিনী অন্তরালে থাকিয়া তাবৎ শুনিয়াছিলেন। এই বিষম কু-সঙ্কল্পকারিদিগের মুখনির্গত যতগুলি শব্দ তাঁহার কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইয়াছিল, ততগুলি বজ্রাঘাত তাঁহার বোধ হইয়াছে। যতক্ষণ না কথোপকথন সমাপ্ত হইয়াছিল, ততক্ষণ বসন্ত-বাতাহত অশ্বত্থ পত্রের ন্যায় তাঁহার ভীতি-কম্পিত তনু কোন মতে দণ্ডামান ছিল; কিন্তু কথা সমাপ্তি হইবামাত্র মাতঙ্গিনী আত্ম-বিবশা হইয়া ভূতলে বসিয়া পড়িলেন।
প্রথমতঃ কিয়ৎক্ষণ ত্রাস ও উৎকট মানসিক যন্ত্রণার আধিক্য প্রযুক্ত বিমূঢ়া হইয়া রহিলেন; ক্রমে মনঃস্থির হইলে দৈব-প্রকাশিত এই বিষম ব্যাপার মনোমধ্যে পরিচালনা করিতে লাগিলেন। এ পর্য্যন্ত তিনি নিজ ভর্ত্তাকে সম্পূর্ণরূপে চিনিতেন না; আজ তাঁহার চক্ষুরুন্মীলিত হইল। চক্ষুরুন্মীলনে যে করাল মূর্ত্তি দেখিলেন, তাহাতে মাতঙ্গিনীর শরীর রোমাঞ্চিত হইল। এ পর্য্যন্ত মনে ভাবিতেন যে, বিধাতা তাঁহাকে ক্রোধ-পরবশ দুর্নীত ব্যক্তির পাণিগৃহিতী করিয়াছেন; আজ জানিলেন যে, তিনি দস্যুপত্নী-দস্যু তাঁহার হৃদয়-বিহারী।