সেই এক দশা আর এই এক দশা। সে উচ্চহাস্য আর কাহার কণ্ঠে? সেই সকল প্রিয়জনই বা কোথায়? আর কি তাঁহাদের মুখ দেখিতে পাইবেন? আর কি তাঁহাদের সেই স্নেহপূর্ণ সম্বোধন কর্ণকুহরে সুধাবর্ষণ করিবে? মনঃপীড়াপ্রদান-পটু স্বামীর হস্তজ্বালিত কালাগ্নি অন্তর্দাহ ব্যতীত আর কিছু কি অদৃষ্টে আছে?

এই সকল দুঃখ চিন্তার মধ্যে একটি গূঢ় বৃত্তান্ত জাগিতেছিল। সে চিন্তা অনুতাপময়ী হইয়াও পরম সুখকরী। মাতঙ্গিনী এ চিন্তাকে হৃদয়-বহিষ্কৃত করিতে যত্ন করিলেন, কিন্তু পারিলেন না। এই গূঢ় ব্যাপার কি তাহা কনক ব্যতীত আর কেহ জানিত না।

দুঃখ-সাগর মনোমধ্যে মন্থন করিয়া তৎস্মৃতিলাভে মাতঙ্গিনী কখন মনে করিতেন, রত্ন পাইলাম; কখন বা ভাবিতেন, হলাহল উঠিল। রত্নই হউক, আর গরলই হউক, মাতঙ্গিনী ভাবিয়া দেখিলেন, তাঁহার কপালে কোন সুখই ঘটিতে পারে না। চক্ষুর্দ্বয় বারিপ্লাবিত হইল।

ক্রমে গ্রীষ্মাতিশয্য দুঃসহ হইয়া উঠিল; মাতঙ্গিনী গবাক্ষ-রন্ধ্র মুক্ত করিবার অভিপ্রায়ে শয্যা ত্যাগ করিয়া তদভিমুখে গমন করিলেন। মুক্ত করেন, এমত সময়ে যেন কেহ শনৈঃ পদসঞ্চারে সেই দিকে অতি সাবধানে আসিতেছিল-এমত লঘু শব্দ তাঁহার কর্ণপ্রবিষ্ট হইল।

‍জানেলাটি যেমন সচরাচর এরূপ গৃহে ক্ষুদ্র হয়, তদ্রূপই ছিল,-দুই হস্ত মাত্র দৈর্ঘ্য, সার্দ্ধেএক হস্ত মাত্র বিস্তার। এ প্রদেশে চালাঘরে মৃত্তিকার প্রাচীর থাকে না, দরমার বেষ্টনীই সর্ব্বত্র প্রথা। রাজমোহনের গৃহেও সেইরূপ ছিল; এবং জানালার ঝাঁপ ব্যতীত কাষ্ঠের আবরণী ছিল ন।

পার্শ্বে যে ছিদ্র দিয়া গৃহমধ্যে জ্যোৎস্না প্রবেশ করিয়াছিল, পদসঞ্চার শ্রবণে ভীতা হইয়া মাতঙ্গিনী সেই ছিদ্র বহির্দ্দিকে দৃষ্টিপাত করিতে যত্ন করিলেন, কিন্তু নীলাম্বরস্পর্শী বৃক্ষশ্রেণীর শিরোভাগ ব্যতীত আর কিছুই দেখিতে পাইলেন না।

মাতঙ্গিনী জানিতেন, যে দিক্ হইতে পদসঞ্চার শব্দ তাঁহার কর্ণাগত হইল, সে দিক্ দিয়া মনুষ্য যাতায়াতের কোন পথ নাই; সুতরাং আশঙ্কা জন্মান বিচিত্র কি? মাতঙ্গিনী নিস্পন্দ শরীরে কর্ণোত্তলন করিয়া তথায় দণ্ডায়মান রহিলেন।

ক্রমশঃ পদক্ষেপণ শব্দ আরও নিকটাগত হইল; পরক্ষণেই দুই জন কর্ণে কর্ণে কথোপকথন করিতেছে শুনিতে পাইলেন। দুই-চারি কথায় মাতঙ্গিনী নিজ স্বামীর কণ্ঠস্বর চিনিতে পারিলেন। তাঁহার ত্রাস ও কৌতূহল দুই-ই সম্বর্দ্ধিত হইল। যথায় মাতঙ্গিনী গৃহমধ্যে দণ্ডায়মানা ছিলেন, আর যথায় আগন্তুক ব্যক্তিরা বিরলে কথোপকথন করিতেছিল, তন্মধ্যে দরমার বেষ্টনীমাত্র ব্যবধান ছিল। সুতরাং মাতঙ্গিনী তৎকথোপকথনের অনেক শুনিতে পাইলেন; আর যাহা শুনিতে পাইলেন না, তাহার মর্ম্মার্থ অনুভবে বুঝিতে পারিলেন।

এক ব্যক্তি কহিতেছিল, “অত বড় বড় করিয়া কথা কহ কেন? তোমার বাড়ীর লোকে যে শুনিতে পাইবে।”

দ্বিতীয় ব্যক্তি উত্তর করিল, “এত রাত্রে কে জাগিয়া থাকিবে?”

মাতঙ্গিনী কণ্ঠস্বরে বুঝিলেন, এ কথা রাজমোহন কহিল।

প্রথম বক্তা কহিল, “কি জানি যদি কেহ জাগিয়া থাকে, আমাদের একটু সরিয়া দাঁড়াইলে ভাল হয়।”

রাজমোহন উত্তর করিল, “বেশ আছি; যদি কেহ জাগিয়াই থাকে, তবে এ ছেঁচের ছায়ার মধ্যে কেহ আমাদিগকে ঠাওর পাইবে না, বরং সরিয়া দাঁড়াইলে দেখিতে পাবে।”