অসম্পূর্ণ রচনা
প্রথম বক্তা জিজ্ঞাসা করিল, “এ ঘরে কে থাকে?”
দ্বিতীয় বক্তা রাজমোহন উত্তর করিল, “সে কথায় দরকার কি?”
প্র ব। বলিতেই বা ক্ষতি কি?
দ্বি ব। এ আমার ঘর, আমার স্ত্রী ভিন্ন আর কেহ থাকেন না।
প্র ব। তুমি ঠিক জান ত, তোমার স্ত্রী ঘুমাইয়াছে?
দ্বি ব। বোধ করি ঘুমাইয়াছে, কিন্তু সেটা ভাল করিয়া জানিয়া আসিতেছি, তুমি এখানে ক্ষণেক দাঁড়াও।
মাতঙ্গিনী পুনরায় পদক্ষেপণ শব্দ শুনিতে পাইলেন; বুঝিলেন, রাজমোহন বাটীর ভিতর আসিতেছে। মাতঙ্গিনী নিঃশব্দে গবাক্ষ সন্নিধান হইতে সরিয়া শয্যায় আসিলেন; এবং এমত সাবধানে তদুপরি আরোহণ করিলেন যে, কিঞ্চিন্মাত্র পদশব্দ হইল না। তথায় নিমীলিত নেত্রে শয়ন করিয়া একান্ত নিদ্রাভিভূতার ন্যায় রহিলেন।
রাজমোহন আসিয়া দ্বারে মৃদু মৃদু করাঘাত করিল। পত্নী আসিয়া দারোদ্ঘাটন করিল না। তখন রাজমোহন মৃদুস্বরে মাতঙ্গিনীকে ডাকিতে লাগিল; তথাপি দ্বারোন্মোচিত হইল না। রাজমোহন বিবেচনা করিল, মাতঙ্গিনী নিদ্রিতা। তথাপি কি জানি এমনই হয় যে, মাতঙ্গিনী সন্ধ্যাকালে ব্যাপারে অভিমানিনী হইয়া নীরব আছেন, এই সন্দেহে রাজমোহন কৌশলে কক্ষাভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে যত্ন করিল। পাকাশালায় গমন করিয়া তথাকার প্রদীপ জ্বালিয়া আনিল; দ্বারের নিকটে প্রদীপ রাখিয়া এক হস্তে একখানা কপাট টানিয়া রাখিয়া এক পদে দ্বিতীয় কবাট ঠেলিয়া ধরিল,-এইরূপে দুই কবাটমধ্যে অঙ্গুলিপ্রবেশের সম্ভাবনা হইলে, দ্বিতীয় হস্তের অঙ্গুলি দ্বারা পরীক্ষা করিয়া দেখিল যে, মাতঙ্গিনী, রাজমোহন স্বেচ্ছাকৃত শয়নাগারে প্রবেশ করিতে পারে, এই অভিপ্রায় কেবলমাত্র কাষ্ঠের “খিল” দিয়া দ্বার বন্ধ করিয়াছিলেন। রাজমোহন অনায়াসে “খিল” বাহির হইতে উদ্ঘাটিত করিল, এবং প্রদীপহস্তে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল।
রাজমোহন দেখিল যে, মাতঙ্গিনীর মুখকান্তি যথার্থ সুষুপ্তি-সুস্থিরের ন্যায় রহিয়াছে। বার কয়েক তাঁহাকে ডাকিল; কোন উত্তর পাইল না। যদি পত্নী অভিমানে নিরুত্তরা থাকে তবে অভিমান ভঞ্জনার্থ দুই চারিটা মিষ্ট কথা কহিল; তথাপি মাতঙ্গিনী নিঃশব্দ রহিয়াছেন, ও ঘন ঘন গভীর শ্বাস বহিতেছে দেখিয়া মনে নিশ্চিত বিবেচনা করিল, মাতঙ্গিনী নিদ্রিতা। সে নিদ্রার ছল করিবে কেন? অতঃপর নিঃসন্দিগ্ধমনে পূর্ব্ব কৌশলে দ্বার বন্ধ করিয়া অন্য কক্ষদ্বারে গমন করিলে দ্বারে দ্বারে সকলকে মৃদুস্বরে ডাকিল, কেহই উত্তর দিল না; সুতরাং সকলেই নিদ্রামগ্ন বিবেচনায় রাজমোহন প্রদীপ নির্ব্বাপিত করিয়া আগন্তুক ব্যক্তির নিকট গমন করিল।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
মাতঙ্গিনী পুনর্ব্বার নিঃশব্দে পদসঞ্চারে শয্যা ত্যাগ করিয়া গবাক্ষসান্নিধ্যে গমন করিলেন; এবং নিম্নোদ্ধৃত মত কথোপকথন শ্রবণ করিলেন।
সকলেই নিদ্রিত, এ সংবাদ রাজমোহন প্রমুখাৎ শ্রবণ করিয়া আগন্তুক কহিল, “তুমি আমাদের এ উপকার করিতে তবে স্বীকার আছ?”
রাজমোহন কহিল, “বড় নহি-আমি কিন্তু তা বলিয়া ভালমানুষির বড়াই করিতেছি না; তবু নেমকহারামি; আমি লোকটাকে দু’চক্ষে দেখিতে পারি না বটে, কিন্তু আমার উপকার অনেক করিয়াছে।”
অপরিচিত ব্যক্তি কহিল, “উপকার করিয়াছে, তবে দেখিতে পার না কেন?”