অসম্পূর্ণ রচনা
মাধব তাহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “কি মাসী, আমার বাড়ীতে বাজার!”
মাসী মৃদুহাস্য করিয়া কহিলেন, “বাছা, মেয়ে মানুষের স্বভাব বকা।”
মাধব কহিলেন, “খুড়ী কোথা, মাসী?”
উত্তর-“আমিও তাই ভাবিতেছিলাম, আজ সকাল বেলা হ’তে কেহই তাঁহাকে দেখে নাই।”
মাধব বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন, “সকাল অবধি নাই! তবে সকলই সত্য!”
মাসী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি সত্য বাপু?”
মাধব। কিছু না-পশ্চাৎ বলিব। খুড়ী তবে কোথায়? কাহারও সঙ্গে কি তাঁহার আজও দেখা হয় নাই?
গৃহিণী ডাকিয়া কহিলেন, “অম্বিকা, শ্রীমতী! তোরা কেহ দেখেছিস?”
তাহারা সকলে সমস্বরে উত্তর করিল “না।”
মাধব কহিলেন, “বড়ই আশ্চর্য্যের কথা।”
পরে অন্তরাল হইতে একজন স্ত্রীলোক মৃদুস্বরে কহিল, “আমি নাবার বেলা বড় বাড়ীতে তাঁকে দেখেছিলাম।”
মাধব অধিকতর বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া কহিলেন, “বড় বাড়ীতে? মথুর দাদার ওখানে!”
তাঁহার মনোমধ্যে এক নূতন সিদ্ধান্ত উপস্থিত হইল। ভাবিলেন, “তবে কি মথুর দাদার কর্ম্ম? না না, তা হ’তে পারে না-আমি অন্যায় দোষ দিতেছি”। পরে প্রকাশ্যে কহিলেন, “করুণা তুই বড় বাড়ীতে যা,-খুড়ীকে ডেকে আন্; যদি না আসেন, তবে কেন আস্বেন না, জিজ্ঞাসা করিস্।”
সপ্তম পরিচ্ছেদ
এদিকে মাতঙ্গিনী স্বামীকৃত তিরস্কারের পর শ্বশ্রূস্বসা কর্ত্তৃক নিজ শয়নকক্ষে আনীত হইলে কক্ষের দ্বার অর্গলবব্ধ করিয়া মনের দুঃখে শয্যাবলম্বন করিলেন। রাত্রে পাকাদি সমাপন হইলে শ্বশ্রূস্বসা তাঁহাকে আহারার্থে ডাকিলেন, কিন্তু মাতঙ্গিনী শয্যাত্যাগ করিলেন না। ননন্দা কিশোরী আসিয়া পিতৃষ্বসার সংযোগে অনেক অনুনয় সাধনাদি করিলেন; কিন্তু তাহাতে কোন ফল হইল না। অবশেষে তাঁহারা নিরস্ত হইলেন-মাতঙ্গিনী অনশনা রহিলেন।
মাতঙ্গিনী শয্যায় শুইয়া আপন অদৃষ্টের বিষয় চিন্তা করিতে লাগিলেন। মাতঙ্গিনীর প্রতি রুষ্ট হইলে রাজমোহন প্রায় শয়নাগারে আসিত না, সুতরাং অদ্য রাত্রে যে আসিবে না, ইহা মাতঙ্গিনী উত্তমরূপে জানিতেন না।
ক্রমে রজনী গভীরা হইল। একে একে গৃহস্থ সকলে নিদ্রামগ্ন হইলেন। সর্ব্বত্র নীরব হইল। মাতঙ্গিনীর শয়নকক্ষে প্রদীপ ছিল না। গবাক্ষরন্ধ্রের আচ্ছাদনীয় পার্শ্ব হইতে চন্দ্রালোক আসিয়া কক্ষতলে পড়িয়াছিল; তদ্ধেতু কক্ষের অংশবিশেষ ঈষৎ আলোকিত হইয়াছিল। তদ্ব্যতীত সর্ব্বত্র অন্ধকার।
প্রকৃত অপরাধে অপমানের যন্ত্রণা সততই এত তীক্ষ্ণ যে, যতক্ষণ না তৎসম্বন্ধীয় বিষময়ী স্মৃতি বিলোপিত হয়, ততক্ষণ মানবদেহে নিদ্রা অনুভূত হইতে পারে না। গ্রীষ্মাতিশয্যপ্রযুক্ত বক্ষঃস্থল হইতে অঞ্চল পদতলে প্রক্ষিপ্ত করিয়া উপাধান-ন্যস্ত বাম ভুজোপরে শিরঃ সংস্থাপন করিয়া মাতঙ্গিনী অশ্রুপূর্ণ লোচনে গৃহতলশোভিনী চন্দ্রপদরেখা প্রতি দৃষ্টি করিতেছিলেন। কেন? সে অমৃত শীতল কিরণ দৃষ্টে কত যে পূর্ব্বসুখ স্মৃতিপথগামী হইল, তাহা কে বর্ণনা করিতে পারে? কৈশোরে কত দিন প্রদোষকালে হেমাঙ্গিনীর সহিত গৃহ-প্রাঙ্গনে এক-শয্যায় শায়িনী হইয়া শিশু-মনোরঞ্জিনী উপকথা কখন বা শ্রবন করিতে করিতে নীলাম্বরবিহারী এই নিশানাথ প্রতি চাহিয়া থাকিতেন, তাহা মনে পড়িল। নীলাম্বর হইতে এই মৃদুল জ্যোতিঃ বর্ষিত হইয়া কত যে হৃদয়-তৃপ্তি জন্মাইত, এ বৃন্তোৎপন্ন কুসুমযুগলবৎ কণ্ঠলগ্না দুই সহোদরা তখন কত যে আন্তরিক সুখে উচ্চহাস্য হাসিতেন, তাহা স্মরণপথে লাগিল।