অসম্পূর্ণ রচনা
যাচকের যাঞ্ছার ভঙ্গী পৃথক্, নিয়মকর্ত্তার ভঙ্গী পৃথক্। মাধব দেখিলেন, রাজমোহন যাচক হইয়া নিয়মকর্ত্তার ন্যায় কথাবার্ত্তা কহিতেছেন; কিন্তু মাধব তাহাতে রুষ্ট না হইয়া বলিলেন, “তাহার আশ্চর্য্য কি? মহাশয় যাইবার পর পক্ষমধ্যে প্রস্তুত বাটী পাইবেন।”
রাজমোহন সম্মত হইল; এবং মাতঙ্গিনীর সহিত মাধবের পশ্চাতে রাধাগঞ্জে যাত্রা করিল।
রাজমোহনের এইরূপ অভিপ্রায় পরিবর্ত্তনের তাৎপর্য্য কি, তাহা প্রকাশ নাই। ফলতঃ এমত অনেকের বোধ হইয়াছিল যে, রাজমোহন এক্ষণে বাটী থাকিতে নিতান্ত অনিচ্ছুক হইয়াছিল; অনিচ্ছার কারণ কি, তাহাও প্রকাশ নাই।
রাধাগঞ্জে উপস্থিত হইয়া মাধব রাজমোহনকে কার্য্যের নামমাত্র ভার দিয়া অতি সুন্দর বেতন নির্দ্ধারণ করিয়া দিলেন; গৃহ নির্ম্মাণ করিতে নিষ্কর ভূমি প্রদান করিলেন; এবং নির্ম্মণ প্রয়োজনীয় তাবৎ সামগ্রী আহরণ করিয়া দিলেন।
রাজমোহন বিনা নিজ ব্যয়ে নিজোপযুক্ত পরিপাটী গৃহ স্বল্পকাল মধ্যে নির্ম্মাণ করিলেন। সেই গৃহের মধ্যেই এই আখ্যায়িকার সূত্রপাত।
রাজমোহন যদিও উচ্চ বেতন-ভোগী হইলেন, কিন্তু মাধব সন্দেহ করিয়া কোনও গুরুতর কার্য্যের ভার দিলেন না।-প্রতিপালনার্থ বেতন দিলেন মাত্র। রাজমোহনের কালক্ষেপনের উপায়াভাব প্রযুক্ত মাধব তাহাকে কৃষকের দ্বারা কর্ষণার্থ বহু ভূমি দান করিলেন; রাজমোহন প্রায় এই কার্য্যেই ব্যাপৃত থাকিতেন।
এইরূপে মাধবের নিকট শোধনাতীত উপকার প্রাপ্ত হইয়া রাজমোহন কোন অংশে কখন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেন না। রাধাগঞ্জে আসা অবধি রাজমোহন, মাধবের প্রতি অপ্রীতিসূচক এবং অপ্রীতিজনক ব্যবহার করিতে লাগিলেন; উভয়ের সাক্ষাৎ সম্ভাবনাদি অতি কদাচিৎ সংঘটন হইত। এইরূপ আচরণে মাধব কখন দৃকপাত করিতেন না-দৃকপাত করিলেও তদ্ধেতু বিরক্তি বা বদান্যতার লাঘব জন্মাইত না। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, মাতঙ্গিনী ও হেমাঙ্গিনী পরস্পর প্রাণতুল্য ভালবাসিতেন, তথাপি তাঁহাদের প্রায় সাক্ষাৎ হইত না। হেমাঙ্গিনী কখন কখন স্বামীকে অনুরোধ করিয়া অগ্রজা সন্নিধানে শিবিকা প্রেরণ করিতেন; কিন্তু রাজমোহন প্রায় মাতঙ্গিনীকে ভগিনীগৃহে গমন করিতে দিতেন না। হেমাঙ্গিনী মাধবের স্ত্রী হইয়াই বা কিরূপে রাজমোহনের বাটীতে আসেন?
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
এক্ষণে আখ্যায়িকার সূত্র পুনঃগ্রহণ করা যাইতেছে। পুষ্পোদ্যান হইতে মাধব বাটীতে প্রত্যাগমন করিলে একজন পত্র-বাহক তাঁহার হস্তে একখানি লিপি প্রদান করিল। লিপির শিরোনামার স্থলে “জরুরি” এই শব্দ দৃষ্টে মাধব ব্যস্ত হইয়া পত্রপাঠে নিযুক্ত হইলেন। সদর মোকামে যে ব্যক্তি তাঁহার মোক্তার নিযুক্ত ছিল, সেই ব্যক্তি এই পত্র প্রেরণ করিয়াছিল। পত্রের মর্ম্ম নিম্নে উদ্ধৃত হইলঃ-
“মহিমার্ণবেষু-
অধীন এ মোকামে থাকিয়া হুজুরের মোকদ্দমা জাতের তদ্বিরে নিযুক্ত আছে, এবং তাহাতে যেমত যেমত আবশ্যক তাহা সাধ্যমত আমলে আনিতেছে। ভরসা করি সর্ব্বত্র মঙ্গল ঘটনা হইবেক। সম্প্রতি অকস্মাৎ যে এক গোলযোগ উপস্থিত হইয়াছে তাহা হুজুরের গোচরে নিবেদন করিতে অধীনের সাহসাভাব। হুজুরের শ্রীমতী খুড়ী ঠাকুরাণীর উকিল হুজুরের নামে অদ্য এ মোকামের প্রধান সদর আপিল আদালতে এই দাবিতে মোকদ্দমা রুজু করিয়াছেন যে, রামগোপাল ঘোষ মহাশয়ের উইলনামা সম্পূর্ণ মিথ্যা তঞ্চক-হুজুর কর্ত্তৃক জাল উইল প্রস্তুত হইয়া বিষয়াদি হইতে তেঁহ বেদস্ত হইয়াছেন। অতএব সমেৎ ওয়াশিলাত তাবৎ বিষয়ে দখল পাওয়ার ও উইল রদের দাবি ইত্যাদি।”