অসম্পূর্ণ রচনা
পত্রী মাধবের হস্তলিখিত হইয়া ভূপতিত হইল। মনে যে তাঁহার কিরূপ ক্রোধাবির্ভাব হইল তাহা বর্ণনা করা দুষ্কর। বহুক্ষণ চিন্তার পর পত্রী মৃত্তিকা হইতে উত্তোলন করিলেন, এবং ললাটের স্বেদস্রুতি করদ্বারা বিলুপ্ত করিয়া পুনঃপাঠে প্রবৃত্ত হইলেন। যথা-
“ইঁহার ছলাদার কে, তাহা অধীন এ পর্য্যন্ত জানিতে পারে নাই; কিন্তু অধীন অনেক অনুসন্ধান করিতেছে ও করিবেক। ফলে এমত বোধ হয় না যে, বিনা ছলা স্ত্রীলোক এরূপ নালিশ উত্থাপন করিবেন। অধীন অদ্য পরম্পরায় শ্রুত হইল যে, কোনও অতি প্রধান ব্যক্তির কুপরামর্শমতে এ ঘটনা উপস্থিত হইয়াছে।”
মাধব মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন যে, এমত ব্যক্তি কে, যে কুপরামর্শ দিয়াছে? মাধব অনেক ভাবিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। কখন একজন প্রতিযোগী প্রতিবাসীর প্রতি সন্দেহ, কখনও বা অপরের প্রতি সন্দেহ করিতে লাগিলেন; কিন্তু কোনও সন্দেহ সমূলক বলিয়া বোধ হইল না।
পত্রপাঠে পুনঃপ্রবৃত্ত হইলেনঃ-
“অধীনের বিবেচনায় হুজুরের কোনও শঙ্কা নাই, কেন না, ‘যতো ধর্ম্মঃ ততো জয়’, কিন্তু যেরূপ বিপক্ষের সহায় দেখা যাইতেছে, তাহাতে সতর্কতার আবশ্যক।-বাবুদিগের এক্ষণে ওকালতনামা দেওয়া আবশ্যক-পশ্চাৎ সময়ে সময়ে সদর হইতে উকীল কৌন্সিলী আনান কর্ত্তব্য হইবেক। তৎপক্ষে হুজুরের যেমন মর্জি। আজ্ঞাধিন প্রাণপণে হুজুরের কার্য্যে নিযুক্ত রহিল-সাধ্যানুসারে ত্রুটি করিবেক না। ইতি তারিখ-
আজ্ঞানুবর্ত্তী শ্রীহরিদাস রায়”।
“পুনশ্চ নিং-
আপাততঃ মোকদ্দমায় খরচ প্রায় হাজার টাকার আবশ্যক হইবেক। যেরূপ হুজুর বুঝিবেন সেইরূপ করিবেন।”
পত্রপাঠ সমাপন মাত্র মাধব, খুল্লতাত-পত্নীর অনুসন্ধানে পুরমধ্যে চলিলেন। ক্রোধে কলেবর কম্পিত হইতেছিল, অতি তরল পদবিক্ষেপে গমন করিতে লাগিলেন;-তাঁহাকে খুল্লতাত-পত্নী কোন্ মুখে জাল সাজ বলিয়া বিচারাগারে ব্যক্ত করিয়াছেন, এ কথা জিজ্ঞাসা করিবেন, এবং তৎক্ষণাৎ খুড়ীকে গৃহবহিষ্কৃত করিয়া দিবেন স্থির করিলেন।
পুরমধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন যে, সন্ধ্যাকাল পাইয়া অন্তঃপুরবাসিনীরা যে হট্টগোল উপস্থিত করিয়াছেন, তাহাতে কর্ণপাত করাই কষ্ট, কথার উত্তর পাওয়া দূরে থাকুক। কোথাও কোন রূপসী-একে স্থূলাকার তাহাতে মেঘের বর্ণ-নানা মত চিৎকার করিয়া এটা ওটা সেটা চাহিতেছে, এবং নানামত মুখভঙ্গী অঙ্গভঙ্গী করিতেছে,-যেন একটা ক্ষুদ্র হস্তিনী কেলি করিতেছে। কোথাও একটি পরিচারিকা তদ্রূপ বিশাল দেহপর্ব্বত লইয়া ব্যস্ত-প্রায় বিবসনা-গৃহ মার্জ্জন করিতেছে; এবং যেমন ত্রিশূলহস্তে অসুরবিজয়িনী প্রমথেশ্বরী প্রতিবার শূলাঘাতে অসুরদল দলিত করিয়াছিলেন, পরিচারিকাও করাল সম্মার্জ্জনী হস্তে রাশি রাশি জঞ্জাল, ওজলা, তরকারির খোসা প্রভৃতি দলিত করিতেছিল, এবং যে আঁটকুড়ীরা এত জঞ্জাল করিয়াছিল তাহাদিগের পতিপুত্রের মাথা মহাসুখে খাইতেছিল। কোথাও অপরা কিঙ্করী আঁস্তাকুড়ে বসিয়া ঘোররবে বাসন মাজিতেছিল,-পাচিকার অপরাধ, সে কেন কড়া বগুনায় পাক করিয়াছিল?-তাই কিঙ্করীর এ গুরুতর কর্ম্মভোগ; যেমন মার্জ্জনা-কার্য্যে তাহার বিপুল করযুগল ঘর্ ঘর্ শব্দে চলিতেছিল, রসনাখানিও তদ্রূপ দ্রুতবেগে পাচিকার চতুর্দ্দশ পুরুষকে বিষ্ঠাদি ভোজন করাইতেছিল। পাচিকা স্বয়ং তখন স্থানান্তরে, গৃহিণীর সহিত ঘৃত লইয়া মহা গোলযোগ করিতেছিলেন, আঁস্তাকুড়ে যে তাঁহার পূর্ব্ব-পুরুষের আহারাদির পক্ষে এমন অন্যায় ব্যবস্থা হইতেছিল, তাহা কিছুমাত্র জানিলেন না-ঘৃতের বিষয়ে একেবারে উন্মত্তা। গৃহিণী পাকার্থ যতটুকু ঘৃত প্রয়োজন ততটুকু দিয়াছেন, কিন্তু পাচিকা তাহাতে সন্তুষ্টা নহেন। তিনি মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন যে, যতটুকু পাকার্থ আবশ্যক তাহার দ্বিগুণ ঘৃত কোন সুযোগে লওয়াই যুক্তি; কারণ, অর্দ্ধেক পাক হইবে, অর্দ্ধেক আত্মসেবার জন্য থাকিবে।