রাজমোহন কর্ম্মঠ, কোনও উপায়ে সংসার প্রতিপালন করিয়া থাকে; তাহার বাটীও নিকটে। এজন্য কন্যাকর্ত্তার ও কন্যাকর্ত্রীর পাত্র মনোনীত হইল,-রাজসিংহাসনের যোগ্য কন্যা মাতঙ্গিনী দুষ্টের দাসী হইলেন। কনিষ্ঠা হেমাঙ্গিনীর প্রতি বিধাতা প্রসন্ন,-মাধবের সহিত তাঁহার পরিণয় হইল।

মাধবের অধ্যয়ন সমাপ্ত হইবার কিছু পূর্ব্বে রামকানাই লোকান্তরে গমন করিলেন। মাধব পিতৃপরলোকের পর প্রায় দারিদ্র্যগ্রস্ত হইতেন, কিন্তু অদৃষ্ট প্রসন্ন। বংশীবদন ঘোষের কনিষ্ট পুত্র রামগোপাল, জ্যেষ্ঠের ন্যায় ধনসম্পত্তিশালী না হইলেও দ্বিতীয়ের ন্যায় হতভাগ্য ছিলেন না। রামগোপাল, রামকানাইয়ের পরই পীড়াক্রান্ত হইয়া প্রাণত্যাগ করিলেন। তাঁহার সন্তানসন্ততি ছিল না। তিনি এই মর্ম্মে উইল করিলেন যে, মাধব তাঁহার তাবৎ সম্পত্তির অধিকারী হইবেক, বিধবা স্ত্রী যত দিন মাধবের ঘরে বাস করিবেন তত দিন তাঁহার নিকট গ্রাসাচ্ছাদন পাইবেন মাত্র।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পিতৃবিয়োগের পরেও মাধব বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন-শেষ পর্য্যন্ত রহিলেন। তাঁহার অনুপস্থিতিকালে তাঁহার কার্য্যকারকেরা বিষয় রক্ষণাবেক্ষণ করিতে লাগিল। পাঠ সমাপ্ত হইলে হেমাঙ্গিনীকে সঙ্গে লইয়া রাধাগঞ্জে গমনোদ্যত হইয়া শ্বশুরালয়ে আগমন করিলেন।

মাতঙ্গিনী তৎকালে পিত্রালয়ে ছিলেন, এবং রাজমোহনও তথায় উপস্থিত ছিলেন। রাজমোহন সময়ের সুযোগ বুঝিয়া মাধবের নিকট নিজের দুঃখকাহিনী প্রকাশ করিলেন; বলিলেন, “পূর্ব্বে কোনরূপ দিন যাপন করিয়াছি, কিন্তু এক্ষণে কাজকর্ম্ম প্রায় রহিত হইয়াছে; আমাদের সহায় মুরুব্বি মহাশয় ব্যতীত আর কেহ নাই। মহাশয় কুবেরতুল্য ব্যক্তি, অনুগ্রহ করিলে অনেকের কাছে বলিয়া দিতে পারেন।”

মাধব জানিতেন যে, রাজমোহন অতি দুর্নীতস্বভাব, কিন্তু সরলা মাতঙ্গিনী তাহার গৃহিণী হইয়া যে গ্রাসাচ্ছদনের ক্লেশ পাইতেছিলেন ইহাতে মাধবের অন্তঃকরণে রাজমোহনের উপর মমতা জন্মাইল। তিনি বলিলেন, “আমার পূর্ব্বাবধি মানস যে, কোন বিশ্বস্ত আত্মীয়ব্যক্তি হস্তে বিষয়কর্ম্মের কিয়দংশ ভার ন্যস্ত করিয়া আপনি কতকটা ঝঞ্ঝাট এড়াই, তা মহাশয় যদি এ ভার গ্রহন করেন তবে ত উত্তমই হয়।”

রাজমোহন মনে মনে বিবেচনা করিল যে, মাধব যে প্রস্তাব করিতেছিলেন তাহাতে রাজমোহনের আশার অতিরিক্ত ফল হইতেছে; কেন না, সে যদি মাধবের জমিদারীর একজন প্রধান কর্ম্মকারক হইতে পারে, তাহা হইলে তাহার উপার্জ্জনের সীমা থাকিবে না। কিন্তু এক দোষ যে, দেশ ছাড়িয়া যাইতে হইবে। রাজমোহন উত্তর করিলেন, “আমার প্রতি মহাশয়ের দয়া যথেষ্ট; কিন্তু যদি মহাশয়ের সহিত যাইতে হয়, তা’হলে পরিবার কাহার কাছে রাখিয়া যাই?”

মাধব বলিলেন, “সে চিন্তার প্রয়োজন কি? একই সংসারে দুই ভগিনী একত্র থাকিবেন, মহাশয়ও আমার বাটীতে যেমন ভাবে ইচ্ছা তেমনই ভাবে থাকিবেন।”

এই শুনিয়া রাজমোহন ভ্রূভঙ্গ করিয়া মাধবের প্রতি চাহিয়া সক্রোধে বলিল,-“না মহাশয়, প্রাণ থাকিতে এমন কখনও পারিব না।”

এই বলিয়া রাজমোহন তদ্দণ্ডেই শ্বশুরালয় হইতে প্রস্থান করিল।

পরদিন প্রাতে রাজমোহন প্রত্যাগমন করিল, এবং মাধবকে পুনরায় কহিল, “মহাশয়, সপরিবারে দূরদেশে যাওয়া আমি পারৎপক্ষে স্বীকার নাহি, কিন্তু কি করি, আমার নিতান্ত দুর্দ্দশা উপস্থিত, সুতরাং আমাকে যাইতেই হইতেছে; কিন্তু একটা পৃথক্ ঘর-দ্বারের বন্দোবস্ত না হইলে যাওয়া যায় না।”