শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
এবংবিধ প্রমাণ গীতা হইতে আরও উদ্ধৃত করা যাইতে পারে।60 প্রমাণ নির্দ্দোষ হইলে, এক প্রমাণই যথেষ্ট। অতএব আর নিষ্প্রয়োজনীয়।
অতএব ইহা সিদ্ধ যে, কর্ম্মযোগ ব্যাখ্যায় কর্ম্ম অর্থে সচরাচর যাহাকে কর্ম্ম বলা যায়, অর্থাৎ কাজ বা action তাহাই ভগবানের অভিপ্রেতঃ-বৈদিক যজ্ঞাদি নহে।
তাহা হইলে এই ৪৭ শ্লোকের অর্থ এই হইতেছে যে, কর্ত্তব্য কর্ম্ম সকল করিতে হইবে। কিন্তু তাহার ফল কামনা করিবে না, নিষ্কাম হইয়া করিবে। এক্ষণে এই মহাকাব্যের প্রকৃত তাৎপর্য্য বুঝিবার চেষ্টা করা যাউক।
ইহার ভিতর দুইটি আজ্ঞা আছে-প্রথম, কর্ম্ম করিতে হইবে। দ্বিতীয়, সকল কর্ম্ম নিষ্কাম হইয়া করিতে হইবে। এক একটি করিয়া বুঝিয়া যাউক। প্রথম, কর্ম্ম করিতে হইবে।
কর্ম্ম করিতে হইবে কেন? তৃতীয়াধ্যায়ের যে দুই শ্লোক উপরে উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহাতেই উহা বুঝান হইয়াছে। কর্ম্ম আমাদের জীবনের নিয়ম-Law of Life-কর্ম্ম না করিয়া কেহ ক্ষণকাল তিষ্ঠিতে পারে না। সকলেই প্রকৃতিজ গুণে কর্ম্ম করিতে বাধ্য হয়। কর্ম্ম না করিলে শরীরযাত্রাও নির্ব্বাহ হয় না। কাজেই সকলকে কর্ম্ম করিতে হইবে।
কিন্তু সকল কর্ম্মই কি করিতে হইবে? কতকগুলি কর্ম্মকে আমরা সৎকর্ম্ম বলি, কতকগুলিকে অসৎকর্ম্ম বলি। অসৎকর্ম্মও করিতে হইবে?
অসৎকর্ম্ম আমাদের জীবন নির্ব্বাহের নিয়ম নহে-ইহা আমাদের Law of Life নহে। অসৎকর্ম্ম না করিয়া কেহ ক্ষণকাল থাকিতে পারে না, এমন নহে;-অসৎকর্ম্ম না করিলে কাহারও শরীরযাত্রা নির্ব্বাহের বিঘ্ন হয় না। চুরি বা পরদার না করিয়া কেহ যে বাঁচিতে পারে না, এমন নহে। সুতরাং অসৎকর্ম্ম করিতে হইবে না। তৃতীয় অধ্যায় হইতে উদ্ধৃত ঐ দুই শ্লোক হইতে বুঝা যাইতেছে, পশ্চাৎ আরও বুঝা যাইবে।
পক্ষান্তরে ইহাও জিজ্ঞাসিত হইতে পারে যে, যাহাকে সৎকর্ম্ম বলি, তাহাই কি আমাদের জীবনযাত্রার নিয়ম? আমরা কতকগুলিকে সৎকর্ম্ম বলি, যথা-পরোপকারাদি; আর কতকগুলিকে অসৎকর্ম্ম বলি, যথা-পরদারগমনাদি; আর কতকগুলিকে সদসৎ কিছুই বলি না, যথা, শয়ন ভোজনাদি। ভাল বুঝা গিয়াছে যে, দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্ম্মগুলি করিবার প্রয়োজন নাই; এবং তৃতীয় শ্রেণীর কর্ম্মগুলি না করিলে নয়, সুতরাং করিতে হইবে। কিন্তু প্রথম শ্রেণীর কর্ম্মগুলি করিব কেন? সৎকর্ম্ম মনুষ্যজীবনের নিয়ম কিসে?
এ কথার উত্তর আমার প্রণীত ধর্ম্মতত্ত্ব নামক গ্রন্থে সবিস্তারে দিয়াছি, সুতরাং পুনরুক্তির প্রয়োজন নাই। আমি সেই গ্রন্থে বুঝাইয়াছি যে, যাহাকে আমরা সৎকর্ম্ম বলি, তাহাই মনুষ্যত্বের প্রধান উপাদান। অতএব ইহা মনুষ্যজীবন নির্ব্বাহের নিয়ম।
বস্তুতঃ কর্ম্মের এই ত্রিবিধ প্রভেদ করা যায় না। যাহাকে সৎকর্ম্ম বলি, আর যাহাকে সদসৎ কিছুই বলি না, অথচ করিতে বাধ্য হই, এতদুভয়ই মনুষ্যত্ব পক্ষে প্রয়োজনীয়। এই জন্য এই দুইকে আমি ধর্ম্মতত্ত্বে অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম বলিয়াছি। এই টীকাতেও বলিতে থাকিব।
এক্ষণে জিজ্ঞাসা হইতে পারে, কোন্ কর্ম্ম অনুষ্ঠেয় এবং কোন্ কর্ম্ম অনুষ্ঠেয় নহে, তাহার মীমাংসা কে করিবে? মীমাংসার স্থূল নিয়ম এই, গীতাতেই কথিত হইয়াছে, পশ্চাৎ দেখিব; এবং সেই নিয়ম অবলম্বন করিয়া আমি উক্ত ধর্ম্মতত্ত্ব গ্রন্থে এ তত্ত্ব কিছু দূর মীমাংসা করিয়াছি।
60 পক্ষান্তরে অষ্টমাধ্যায়ে, “ভূতভাবোদ্ভবকরো বিসর্গ: কর্ম্মসংজ্ঞিত:” ইতি বাক্যও আছে। তাহার প্রচলিত অর্থ যজ্ঞ পক্ষে বটে কিন্তু সেই প্রচলিত অর্থও যে ভ্রমাত্মক, বোধ করি পাঠক তাহা পশ্চাৎ বুঝিতে পারিবেন। আমি বুঝাইব, এমন কথা বলি না-পাঠক সহজেই বুঝিবেন। এবং ইহাও স্বীকার করিতে আমি বাধ্য যে, কখন কখন গীতাকেও কর্ম্ম শব্দে বৈদিক কাম্য কর্ম্ম বুঝায়, যথা-এই যে অধ্যায়ের ৪৯ শ্লোকে, “দূরেণ হ্যবরং কর্ম্ম”। কিন্তু এখানেও স্পষ্টই বুঝা যায়, এ “কর্ম্মের” সঙ্গে কর্ম্মযোগের বিরুদ্ধ ভাব। গীতায় অনেকগুলি শব্দ ভিন্ন ভিন্ন অর্থে স্থানে স্থানে ব্যবহৃত হইয়াছে, ইহা পূর্বেই বলিয়াছি।