তৃতীয় অধ্যায়

অর্জ্জুন উবাচ।

জ্যায়সী চেৎ কর্ম্মণস্তে মতা বুদ্ধির্জনার্দ্দন।
তৎ কিং ঘোরে মাং নিয়োজরসি কেশব || ১ ||

হে জনার্দ্দন! যদি তোমার মতে কর্ম্ম হইতে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ, তবে হে কেশব! আমাকে হিংসাত্মক কর্ম্মে কেন নিযুক্ত করিতেছ? ১।

বুদ্ধি অর্থে এখানে আবার কেন জ্ঞান বুঝিতে হইতেছে। ভগবান্ অর্জ্জুনকে যুদ্ধ করিতে বলিয়াছেন, কিন্তু দ্বিতীয়াধ্যায়ের শেষ কয়েক শ্লোকে, অর্থাৎ স্থিতপ্রজ্ঞের লক্ষণে অর্জ্জুন এইরূপ বুঝিয়াছেন যে, জ্ঞান কর্ম্ম হইতে শ্রেষ্ঠ। তাই জিজ্ঞাসা করিতেছেন যে, যদি জ্ঞানই কর্ম্ম হইতে শ্রেষ্ঠ, তবে আমাকে কর্ম্মে, বিশেষ যুদ্ধের ন্যায় নিকৃষ্ট কর্ম্মে কেন নিযুক্ত করিতেছ?

অর্জ্জুনের এইরূপ সংশয় কিরূপে উপস্থিত হইল, শ্রীধর তাহা এইরূপে বুঝাইয়াছেন, “অশোচ্যনন্বশোচস্ত্বম্” (দ্বিতীয়াধ্যায়ের ১১শ শ্লোক দেখ) ইত্যাদি বাক্যের দ্বারা প্রথমে মোক্ষসাধনজন্য দেহাত্মবিবেকবুদ্ধির কথা বলিয়া, তাহার পর “এষা তেহভিহিতা সাংখ্যে বুদ্ধিঃ” ইত্যাদি বাক্যে (দ্বিতীয়াধ্যায়ের ৩৯ শ শ্লোক দেখ) কর্ম্মও কথিত হইয়াছে। কিন্তু এতদুভয় মধ্যে গুণপ্রধান ভাব স্পষ্টতঃ দেখান হয় নাই। তথা বুদ্ধিযুক্ত স্থিতপ্রজ্ঞের নিষ্ক্রিয়ত্ব, নিয়তেন্দ্রিয়ত্ব, নিরহঙ্কারত্ব ইত্যাদি লক্ষণের গুণবাদে “এষা ব্রাহ্মী স্থিতিঃ পার্থ” (৭২ শ্লোক দেখ) সপ্রশংস উপসংহারে, বুদ্ধি ও কর্ম্ম, এতন্মধ্যে বুদ্ধির শ্রেষ্ঠত্বই ভবানের অভিপ্রায় বুঝিয়াই অর্জ্জুন এইরুপ জিজ্ঞাসা করিয়াছেন।

বস্তুতঃ দ্বিতীয়াধ্যায়ে স্পষ্টতঃ কোথাও বলেন নাই যে,কর্ম্ম হইতে জ্ঞান শ্রেষ্ঠ।তবে ৪৯ শ্লোকে কিছু গোলযোগ ঘটিয়াছে বটে, “দূরেণ হ্যবরং কর্ম্ম বুদ্ধিযোগাদ্ধনঞ্জয়।”

এখানে ভাষ্যকারেরা যে বুদ্ধি অর্থে ব্যবসায়াত্মিকা কর্ম্মযোগ বুঝাইয়াছেন, তাহাও উক্ত শ্লোকের ব্যাখ্যাকালে বুঝাইয়াছি। সেখানে এই অর্থ পরিত্যাগ করিয়া, বুদ্ধি অর্থে জ্ঞান বুঝিলে আর কোনও গোল থাকে না। নচেৎ এইখানে গোলযোগ উপস্থিত হয়, এ কথাও পূর্ব্বে বলিয়াছি। আনন্দগিরিও এই তৃতীয়ের প্রথম শ্লোকের ভাষ্যের টীকায় “দূরেণ হ্যবরং কর্ম্ম” ইত্যাদি শ্লোকটি বিশেষরূপে নির্দ্দিষ্ট করিয়াছেন।

যাহাই হউক জ্ঞান কর্ম্মের গুণপ্রাধান্য সম্বন্ধে দ্বিতীয়াধ্যায়ের ভগবদুক্তি যাহা আছে, তাহা কিছু “ব্যামিশ্র” (anglice ambiguous) বটে। বোধ হয়, ইচ্ছাপূর্ব্বকই ভগবান্ কথা প্রথমে পরিস্ফুট করেন নাই-এই প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা করিয়াছিলেন। কেন না, এই প্রশ্নের উত্তর উপলক্ষে পরবর্ত্তী কয়েক অধ্যায়ে জ্ঞান-কর্ম্মের তারতম্য ও পরস্পর সম্বন্ধ বিষয়ে যে মীমাংসা হইয়াছে, ইহা মনুষ্যের অনন্ত মঙ্গলকর,এবং ইহাকে অতিমানুষে-বুদ্ধি-প্রসূত বলিয়াই স্বীকার করিতে হয়। আর কোথাও কখনও ভূমণ্ডলে এরূপ সর্ব্বমঙ্গলময় ধর্ম্ম কথিত হয় নাই।

অর্জ্জুন সেই “ব্যামিশ্র” বাক্যের কথাই বিশেষ করিয়া বলিতেছেন-

ব্যামিশ্রেণেব বাক্যেন বুদ্ধিং মোহয়সীব মে।
তদেকং বদ নিশ্চিত্য যেন শ্রেয়োহহমাপ্নুয়াম্ || ২ ||

ব্যামিশ্র (সন্দেহজনক) বাক্যের দ্বারা আমার মন মুগ্ধ করিতেছ। অতএব যাহার দ্বারা আমি শ্রেয় প্রাপ্ত হইব, সেই একই (এক প্রকার নিষ্ঠাই) আমাকে নিশ্চিত করিয়া বলিয়া দাও। ২।

শ্রীভগবানুবাচ।

লোকেহস্মিন্ দ্বিবিধা নিষ্ঠা পুরা প্রোক্তা ময়ানঘ।
জ্ঞানযোগেন সাংখ্যানাং কর্ম্মযোগেন যোগিনাম্ || ৩ ||

হে অনঘ! ইহলোকে দ্বিবিধা নিষ্ঠা আছে, ইহা পূর্ব্বে বলিয়াছি।অর্থাৎ সাংখ্যদিগের জ্ঞানযোগ এবং (কর্ম্ম) যোগীদিগের কর্ম্মযোগ বলিয়াছি। ৩।