এই শ্লোকোক্ত প্রথম বিধি, “কর্ম্ম করিবে,” তৎসম্বন্ধে এক্ষণে এই পর্য্যন্ত বলিয়া দ্বিতীয় বিধি সামান্যতঃ বুঝাইব। দ্বিতীয় বিধি এই যে, যে কর্ম্ম করিবে, তাহা নিষ্কাম হইয়া করিবে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাউক।

পরোপকার অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম। অনেকে পরোপকার এইরূপ অভিপ্রায়ে করিয়া থাকে যে, আমি যাহার উপকার করিলাম, সে আমার প্রত্যুপকার করিবে। ইহা সকাম কর্ম্ম। ইহা এই বিধির বহির্ভূত।

অনেকে এই অভিপ্রায়ে দানাদির দ্বারা পরোপকার করে যে, ইহাতে আমার পুণ্যসঞ্চয় হইয়া তৎফলে স্বর্গাদি লাভ হইবে। ইহাও সকাম কর্ম্ম, এবং এই বিধির বহির্ভূত।

অনেকে এইরূপ অভিপ্রায়ে পরোপকার করিয়া থাকেন যে, ঈশ্বর ইহাতে আমার উপর প্রসন্ন হইবেন, এবং প্রসন্ন হইয়া আমার মঙ্গল করিবেন। তাহা হইতে পারে; ঈশ্বর প্রসন্ন হইবেন সন্দেহ নাই এবং পরোপকারীর মঙ্গলও করিতে পারেন; কিন্তু ইহা নিষ্কাম কর্ম্ম নহে। ইহা সকাম, এবং এই বিধির বহির্ভূত।

নিষ্কামকর্মী তাহাও চাহে না; কিছুই চাহে না, কেবল আপনার অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম করিতে চাহে। পরোপকার আমার অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম-এই জন্য আমি করিব, কোন ফলই চাই না। ইহা নিষ্কাম চিত্তভাব।

ধর্ম্মতত্ত্বে আমি আর আর উদাহরণের দ্বারা বুঝাইয়াছি যে, সকল প্রকার অনুষ্ঠেয় কর্ম্মই নিষ্কাম হইতে পারে। অতএব পুনরুক্তি অনাবশ্যক।

নিষ্কাম কর্ম্ম সম্বন্ধে একটি প্রথম কথা। এ তত্ত্ব ক্রমশঃ আরও পরিস্ফুট ও বিশদ হইবে।

যোগস্থঃ কুরু কর্ম্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়।
সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে || ৪৮ ||

হে ধনঞ্জয়! যোগস্থ হইয়া “সঙ্গ” ত্যাগ করিয়া কর্ম্ম কর। সিদ্ধি ও অসিদ্ধিকে তুল্য জ্ঞান করিয়া (কর্ম্ম কর)। (এইরূপ) সমত্বকে যোগ বলে। ৪৮।

পূর্ব্বশ্লোকে ফলাকাঙ্ক্ষাশূন্য যে কর্ম্ম, তাহাই বিহিত হইয়াছে। এক্ষণে সেইরূপ কর্ম্ম করার পক্ষে তিনটি বিধি নির্দ্দিষ্ট হইতেছে-

প্রথম, যোগস্থ হইয়া কর্ম্ম করিবে।

দ্বিতীয়, সঙ্গ ত্যাগ করিয়া কর্ম্ম করিবে।

তৃতীয়, সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে তুল্যজ্ঞান করিবে।

ক্রমশঃ এই তিনটি বিধি বুঝিতে চেষ্টা করা যাউক।

প্রথম, যোগস্থ হইয়া কর্ম্ম করিবে। যোগ কি? যোগ শব্দ গীতায় স্থানে স্থানে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে, ইহা পূর্ব্বে বলিয়াছি। পাঠককে বুঝাইতে হইবে না যে, যাহাকে পতঞ্জলি ঠাকুর “চিত্তবৃত্তিনিরোধ” বলিয়াছেন, সেরূপ কথা হইতেছে না।

এখানে “যোগ” শব্দের অর্থ শ্রীধর স্বামীর মতে “পরমেশ্বরৈকপরতা।” শঙ্করাচার্য্যও তাহাই বুঝিয়াছেন। তিনি বলেন, “যোগস্থ সন্ কুরু কর্ম্মাণি কেবলমীশ্বরার্থম্।” কিন্তু শ্লোকের শেষাংশের ব্যাখ্যাবলে তিনি বলিয়াছেন, “কোহসৌ যোগো যত্রস্থঃ কুর্ব্বিতুক্তমিদমেব তৎ সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোঃ সমত্বং যোগ উচ্যতে।”

স্থূল কথা, যোগ কি, তাহা যখন এই শ্লোকেই ভগবান্ বুঝাইয়াছেন, তখন আর ভিন্ন অর্থ খুঁজিবার প্রয়োজন কি? সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে যে সমত্বজ্ঞান, তাহাই যোগ। তৃতীয় বিধি বুঝিলেই তাহা বুঝিব। তৃতীয় বিধি, প্রথম বিধির সম্প্রসারণ মাত্র। সম্প্রসারণকে পুনরুক্তি বলা যায় না।

তৃতীয় বিধির আগে দ্বিতীয় বিধি বুঝা যাউক। “সঙ্গ” ত্যাগ করিয়া কর্ম্ম করিবে। সঙ্গ কি? শ্রীধর বলেন, “কর্ত্তৃত্বাভিনিবেশঃ।” আমি কর্ত্তা, এই অভিনিবেশ পরিত্যাগ করিয়া, কেবল ঈশ্বরাশ্রয়ে অর্থাৎ ঈশ্বরই কর্ত্তা, ইহা জানিয়া কর্ম্ম করিবে।

শঙ্কর বলেন, “যোগস্থঃ সন্ কুরু কর্ম্মাণি, কেবলমীশ্বরার্থং তত্রাপীশ্বরো মে তুষ্যত্বিতি সঙ্গং ত্যক্ত্বা,” কেবল ঈশ্বরার্থ কর্ম্ম করিবে, কিন্তু ঈশ্বর তজ্জন্য আমার শুভ করুন, এরূপ কামনা পরিত্যাগ করিয়া কর্ম্ম করিবে। ফলে, ফলকামনা ত্যাগই সঙ্গত্যাগ, এইরূপ অর্থে “সঙ্গ” শব্দ পুনঃ পুনঃ গীতায় ব্যবহৃত হইয়াছে, দেখা যায়।