শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
বোধ হয় এক্ষণে শ্লোকের অর্থ বুঝা গিয়াছে। ইহাই সুবিখ্যাত নিষ্কাম কর্ম্মতত্ত্ব। এরূপ উন্নত, পবিত্র এবং মনুষ্যের মঙ্গলকর মহামহিমাময় ধর্ম্মোক্তি জগতে আর কখন প্রচারিত হয় নাই। কেবল ভগবৎপ্রসাদাৎই হিন্দু, এরূপ পবিত্র ধর্ম্মতত্ত্ব লাভ করিতে পারিয়াছে।
কিন্তু লাভ করিয়াও হিন্দুর পক্ষে ইহার বিশেষ ফলোপধায়িতা ঘটে নাই। তাহার কারণ, এমন কথাতেও আমাদের বুদ্ধিবিভ্রংশবশতঃ অনেক গোলযোগ ঘটিয়াছে। আমরা আজিও ভাল করিয়া ইহা বুঝিতে পারি নাই।
আমি এমন বলিতেছি না যে, আমি ইহা সম্পূর্ণরূপে বুঝিয়াছি বা পাঠককে সম্পূর্ণরূপে বুঝাইতে পারিব। ভগবান্ যাঁহাকে তাদৃশ অনুগ্রহ করিবেন, তিনিই ইহা বুঝিতে পারিবেন। তবে যতটুকু পারি, বুঝাইতে চেষ্টা করায় বোধ হয় ক্ষতি নাই।
ইহার প্রথম গোলযোগ কর্ম্ম শব্দের অর্থ সম্বন্ধে। যাহা করা যায় বা করিতে হয়, তাহাই কর্ম্ম, কর্ম্ম শব্দের এই প্রচলিত অর্থ। কিন্তু কতকগুলি হিন্দু শাস্ত্রকার বা হিন্দু শাস্ত্রের ব্যাখ্যাকার ইহাতে একটা গোলযোগ উপস্থিত করিয়া রাখিয়াছেন। তাঁহাদের কৃপায় এ সকল স্থলে বুঝিতে হয়, কর্ম্ম অর্থে বেদোক্ত যজ্ঞাদি। কর্ম্ম মাত্রই কর্ম্ম নহে-বেদোক্ত অথবা শাস্ত্রোক্ত যজ্ঞই কর্ম্ম।
যদি তাই হয়, তাহা হইলে এই শ্লোকের অর্থ এই বুঝিতে হয় যে, বেদোক্তাদি যজ্ঞাদি করিবে, কিন্তু সেই সকল যজ্ঞের ফল স্বর্গাদি, সেই স্বর্গাদির কামনা করিবে না।
এইরূপ অর্থ চিরপ্রচলিত বলিয়া সুশিক্ষিত ইংরেজিনবিশেরাও এইরূপ অর্থ বুঝিয়াছেন। সুপণ্ডিত কাশীনাথ ত্র্যম্বক তেলাঙ্ ইহার পূর্ব্ব-শ্লোকের টীকায় লিখিয়াছেন, “The Vedas… prescribe particular rites and ceremonies for going to heaven or destroying an enemy &c. But, says Krishna, man’s duty is merely to perform the actions prescribed for him among these, and not entertain desires for the special benefits named.”
যদি কর্ম্ম শব্দের এই অর্থ হয়, তবে পাঠককে একটু গোলযোগে পড়িতে হইবে। পাঠক বলিলেন যে, যে কর্ম্মের ফল স্বর্গাদি, অন্য কোন প্রয়োজন নাই, যদি সে ফলই কামনা না করিলাম, তবে সে কর্ম্মই করিব কেন? নিষ্কাম কাম্য কর্ম্ম কিরূপ? কাম্য কর্ম্ম নিষ্কাম হইয়াই বা করি কেন?
অতএব দেখা যাইতেছে যে, কর্ম্ম অর্থে বেদোক্তাদি কাম্য কর্ম্ম বুঝিলে আমরা কোন বোধগম্য তত্ত্বে উপস্থিত হইতে পারি না। আর বেদোক্ত কাম্য কর্ম্ম গীতোক্ত নিষ্কাম কর্ম্মের উদ্দিষ্ট নহে, তাহা গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের আলোচনায় অতি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। ঐ তৃতীয় অধ্যায়ের নামই “কর্ম্মযোগ”। ইহাতে কর্ম্ম সম্বন্ধে কথিত হইয়াছে-
ন হি ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্ম্মকৃৎ।
কার্য্যতে হ্যবশঃ কর্ম্ম সর্ব্বপ্রকৃতিজৈর্গুণৈঃ || ৫ ||
কার্য্যতে হ্যবশঃ কর্ম্ম সর্ব্বপ্রকৃতিজৈর্গুণৈঃ || ৫ ||
“কেহ কখন ক্ষণমাত্র কর্ম্ম না করিয়া থাকিতে পারে না; কেন না, প্রকৃতিজ বা স্বাভাবিক গুণে সকলকেই কর্ম্ম করিতে বাধ্য করে।”
এখন দেখা যাইতেছে, বেদোক্ত যজ্ঞাদি সম্বন্ধে এ কথা কখনই বলা যায় না। কেবল সচরাচর যাহাকে কর্ম্ম বলি-যাহাকে ভাষায় কাজ এবং ইংরেজিতে action বলে, তাহার সম্বন্ধেই কেবল এ কথা বলা যাইতে পারে। কেহ কখন কাজ না করিয়া থাকিতে পারে না, অন্য কোন কাজ না করুক, স্বভাব বা প্রকৃতির (Nature) বশীভূত হইয়া কতকগুলি কাজ অবশ্য করিতে হইবে। যথা,-অশন, বসন, শয়ন, শ্বাস, প্রশ্বাস ইত্যাদি। অতএব স্পষ্টই কর্ম্ম শব্দে বাচ্য, যাহাকে সচরাচর কর্ম্ম বলা যায়, তাহাই; যজ্ঞাদি নহে।
পুনশ্চ ঐ অধ্যায়ের ৮ম শ্লোকে কথিত হইতেছে-
নিয়তং কুরু কর্ম্ম ত্বং কর্ম্ম জ্যায়ো হ্যককর্ম্মণঃ।
শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিধ্যেদকর্ম্মণঃ ||
শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিধ্যেদকর্ম্মণঃ ||
“তুমি নিয়ত কর্ম্ম কর; কর্ম্ম অকর্ম্ম হইতে শ্রেষ্ঠ; অকর্ম্মে তোমার শরীরযাত্রাও নির্ব্বাহ হইতে পারিবে না।”
এখানেও নিশ্চিত কর্ম্ম সর্ব্ববিধ কর্ম্ম বা ‘কাজ’;-যজ্ঞাদি নহে। যজ্ঞাদি ব্যতীত সকলেরই শরীরযাত্রা নির্ব্বাহ হইতে পারে ও হইয়া থাকে, কেবল কাজ বা Action যাহাকে সচরাচর কর্ম্ম বলা যায়, তাহা ভিন্ন শরীরযাত্রা নির্ব্বাহ হয় না।