প্রবাদ আছে যে, পুরাণাদি প্রণয়নের পর ব্যাসদেব এক দিন সমুদ্রতীরে উপবেশন করিয়া কি চিন্তা করিয়াছিলেন। সমুদ্রে বৃহৎ বৃহৎ ঊর্ম্মি-মালার মত তাঁহারও মানসসমুদ্রে গুরুতর চিন্তা উঠিয়া মনকে অশান্ত করিয়া তুলিয়াছিল। সেই সময়ে দেবর্ষি নারদ তাঁহার নিকট উপস্থিত হন। নারদের নিকট ব্যাসদেব মনের অবস্থা বিবৃত করেন; বলেন,-প্রভু, জগতের হিতার্থ আমি সাধারণের দুর্ব্বোধ্য বেদোক্ত ধর্ম্মকে সহজ করিয়া প্রচার করিয়াছি, গল্পচ্ছলে বেদোক্ত উপদেশ লইয়া পুরাণাদি প্রণয়ন করিয়াছি, ইহাতে আমার জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হইয়াছে। তথাপি এখন আমার মনে হইতেছে, বুঝি আমার কর্ত্তব্য কিছুই করা হয় নাই, অথচ আর আমি কি করিব, নির্ণয় করিতে পারিতেছি না। এই জন্য মন অতিশয় ব্যাকুল হইয়াছে-অশান্ত মনে সমুদ্রতীরে আসিয়াছি-দেব! কোথায় আমার কর্ত্তব্যের ত্রুটি হইয়াছে, আরও আমার কি কর্ত্তব্য বাকি আছে, নির্দ্দেশ করিয়া আমার এই অশান্ত মনে শান্তি প্রদান করুন। “ধর্ম্মের প্রধান অবলম্বন ভক্তি জগতে প্রচার কর”-এই উপদেশ দিয়া দেবর্ষি অন্তর্হিত হইলেন। কথিত আছে যে, ব্যাসদেব তখন ভাগবত ও ভগবদ্গীতা প্রণয়ন করেন, আরও দুই একখানি পুরাণে ভক্তের আদর্শ অঙ্কন করেন। এই কারণে কেহ কেহ মহাভারত গীতার পূর্ব্বে রচিত হইয়াছিল, অনুমান করেন।

গীতাও ভাগবত ভক্তিপ্রধান গ্রন্থ। ব্যাসদেব বুঝিয়াছিলেন, ভক্তি জীবনের চরম উদ্দেশ্য, পরিত্রাণের একমাত্র উপায়।

কি কথাটা হইতেছিল, এক্ষণে এক বার স্মরণ করা কর্ত্তব্য। ভগবান্ অর্জ্জুনকে জ্ঞানযোগ বুঝাইয়া “এষা তেহভিহিতা সাংখ্যে” ইত্যাদি বাক্যে বলিলেন যে, এখন তোমাকে কর্ম্মযোগ শুনাইব। তখন কর্ম্মযোগের কিছু প্রশংসা করিয়া, প্রথমতঃ একটা সাধারণ প্রচলিত ভ্রান্তির নিরাসে প্রবৃত্ত হইলেন। সে ভ্রান্তি এই যে, বেদোক্ত কাম্য কর্ম্ম সকলেই লোকের চিত্ত নিবিষ্ট, তাদৃশ লোক ঈশ্বরে একাগ্রচিত্ত হইতে পারে না। তাই ভগবান্ অর্জ্জুনকে বলিলেন যে, বেদ সকল “ত্রৈগুণ্যবিষয়,” তুমি নিস্ত্রৈগুণ্য হও বা বেদবিষয়কে অতিক্রম কর। কেন না, যেমন সর্ব্বত্র জলপ্লাবিত হইলে বাপী কূপ তড়াগাদিতে কাহারও প্রয়োজন হয় না, তেমনি যে ব্রহ্মনিষ্ঠ, বেদে আর তাহার প্রয়োজন হয় না। কর্ম্মযোগের সহিত বৈদিক কর্ম্মের সম্বন্ধরাহিত্য এইরূপে প্রতিপাদন করিয়া ভগবান্ এক্ষণে কর্ম্মযোগ কহিতেছেন;-

কর্ম্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্ম্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্ম্মাণি || ৪৭ ||

কর্ম্মে তোমার অধিকার, কিন্তু ফলে কদাচ (অধিকার) না হউক। তুমি কর্ম্মফলহেতু হইও না; অকর্ম্মে তোমার আসক্তি না হউক।৪৭।

এই শ্লোক বুঝিতে গেলে, “কর্ম্ম” কি, “কর্ম্মফলহেতু” কি, “অকর্ম্ম” কি, বুঝা চাই।

“কর্ম্ম কি” বুঝিলে, আর দুইটা বুঝা গেল। কর্ম্মফল যাহার প্রবৃত্তি হেতু, সেই “কর্ম্মফলহেতু”। কর্ম্মশূন্যতাই অকর্ম্ম। কর্ম্ম কি, তাহা পরে বলিতেছি।

অতএব শ্লোকের অর্থ এই যে, কর্ম্ম করিও, কিন্তু কর্ম্মফল কামনা করিও না। কর্ম্মফলপ্রাপ্তিই যেন তোমার কর্ম্মে প্রবৃত্তির হেতু না হয়। কিন্তু কর্ম্মের ফলের প্রত্যাশা না থাকিলে কেহ কর্ম্ম করিতে প্রবৃত্ত হইবার সম্ভাবনা নাই, এই জন্য শ্লোকশেষে তাহাও নিষিদ্ধ হইতেছে। বলা হইতেছে, ফল চাহি না বলিয়া কর্ম্মে বিরত হইও না। অর্থাৎ কর্ম্ম অবশ্য করিবে, কিন্তু ফল কামনা করিয়া কর্ম্ম করিবে না।