শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
এই যাবৎ তাবৎ শব্দের পরস্পরের সম্বন্ধ এই, যে বস্তুর সঙ্গে যাবৎ থাকে, আর যাহার সঙ্গে তাবৎ থাকে, উভয়ের পরিমাণ এক বা সমান বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হয়। অতএব যাবৎ তাবৎ থাকিলে দুইটি তুল্য বা তুলনার বস্তু আছে, ইহাই বুঝিতে হইবে। “আমি যাবৎ না আসি, (তাবৎ) তুমি এখানে থাকিও।”-এই বাক্যের প্রকৃত তাৎপর্য্য এই যে, “আমার পুনরাগমন পর্য্যন্ত যে কাল, আর তোমার এখানে অবস্থিতিকাল, উভয়ে সমান হইবে।” এখানে এই দুইটি সময় তুল্য বা তুলনীয়।
এইরূপে যেখানে একটি যাবান্ আর একটি তাবান্ আছে, সেখানেও বুঝিতে হইবে যে, দুইটি বিষয় পরস্পর তুলিতে হইতেছে। যদি তার পর আবার যাবান্ তাবান্ দেখি, তবে অবশ্য বুঝিতে হইবে যে, আবার আরও দুইটি পরস্পর তুলিত হইতেছে। ইহার অন্যথা কদাচ হইতে পারে না।
এখন এই শ্লোকের মূলে মোটে একটি যাবান্ আর একটি তাবান্ আছে; অতএব বুঝিতে হইবে, দুইটি বিষয় মাত্র পরস্পর তুলিত হইতেছে, অর্থাৎ (১) উদপানে বা সঙ্কীর্ণ জলাশয়ে অবস্থাবিশেসে যাবৎ পরিমিত প্রয়োজন, (২) সমস্ত বেদে অবস্থাবিশেষে তাবৎ প্রয়োজন। কিন্তু প্রাচীন টীকাকারদিগের কৃত যে ব্যাখ্যা, যাহার উদাহরণ উপরে উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহাতে দেখি যে দুইটা যাবান্ এবং দুইটা তাবান্।58 অতএব বুঝিতে হইবে যে, প্রথমে দুইটা বস্তু পরস্পর তুলিত হইলে পর, আবার দুইটা বস্তু পরস্পর তুলিত হইয়াছে। প্রথম, সঙ্কীর্ণ জলাশয়ের সঙ্গে সমস্ত বেদ তুলিত না হইয়া মহাহ্রদের সঙ্গে তুলিত হইতেছে। তার পরে আবার সমস্ত বেদ, সঙ্কীর্ণ জলাশয়ের সঙ্গে সম্বন্ধ ছাড়িয়া ব্রহ্মনিষ্ঠার সঙ্গে তুলনা প্রাপ্ত হইল। ইহাতে কোন অর্থবিপর্য্যয় ঘটিতেছে কি না?
সচরাচর এ প্রশ্নের এই উত্তর যে, কোন অর্থবিপর্য্যয় ঘটিতেছে না। কেন না, যাবান্ তাবান্ যেখানে নাও থাকে, সেখানে ব্যাখ্যার প্রয়োজনানুসারে ব্যাখ্যাকারকে বসাইয়া লইতে হয়; তাহার উদাহরণ পূর্ব্বে দেওয়া গিয়াছে। এ কথার এখানে দুইটি আপত্তি উপস্থিত হইতেছে।
প্রথম আপত্তি এই। মানিলাম যে, প্রয়োজনানুসারে ব্যাখ্যাকার যাবান্ তাবান্ বসাইয়া লইতে পারেন। কিন্তু যাবান্ কাটিয়া তাবান্ করিতে, তাবান্ কাটিয়া যাবান্ করিতে পারেন কি? আমি যদি বলি, আমি যাবৎ না আসি, তুমি এখানে থাকিও, তাহা হইলে ব্যাখ্যাকার তাবৎ শব্দ বসাইয়া লইয়া ‘তাবৎ তুমি এখানে থাকিও’ বলিতে পারেন। কিন্তু তিনি যদি যাবৎ কাটিয়া তাবৎ করেন, যদি বলেন যে, এই বাক্যের অর্থ ‘আমি তাবৎ না আসি, যাবৎ তুমি এখানে থাকিও’ তাহা হইলে তাঁহার ব্যাখ্যা অগ্রাহ্য ও মূলের বিপরীত বলিতে হইবে।
আরও একটা উদাহরণের দ্বারা কথাটা আরও স্পষ্ট করা যাউক। “যাবৎ তোমার জীবন, তাবৎ আমার সুখ।” (ক)
এই বাক্যটি উদাহরণ-স্বরূপ গ্রহণ কর, এবং তাহাতে (ক) চিহ্ন দাও। তার পর উহার যাবৎ কাটিয়া তাবৎ কর, তাবৎ কাটিয়া যাবৎ কর। তাহা হইলে বাক্য এইরূপ দাঁড়াইতেছে। “তাবৎ তোমার জীবন, যাবৎ আমার সুখ।” (খ)
এখন দেখ, বাক্যার্থের কিরূপ বিপর্য্যয় ঘটিল। (ক)-চিহ্নিত বাক্যের প্রকৃত অর্থ যে, “তুমি যত দিন বাঁচিবে, তত দিনই আমি সুখী, তার পর আর সুখী হইব না।” (খ)-চিহ্নিত বাক্যের প্রকৃত অর্থ “যত দিন আমি সুখী থাকিব, তত দিন তুমি বাঁচিবে, তার পর আর তুমি বাঁচিবে না।” অর্থের সম্পূর্ণ বিপর্য্য ঘটিল।
58 পুরু অক্ষরে এই চারিটা শব্দ ছাপিয়াছি, পাঠক মিলাইয়া দেখিবেন।